ক্যান্সার চিকিৎসায় মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির ব্যাবহার ও গবেষণা
ডঃশুভময়ব্যানার্জী, পি.এইচ.ডি Neucrad Health Desk http://www.fb.com/neucradhealthbengali September 20,2021
সাম্প্রতিককালে ক্যান্সার চিকিৎসায় মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যাবহার করে বিশেষ ফল পাওয়া যাচ্ছে। এই অ্যান্টিবডির ব্যাবহার মানুষের ইমিউন সিস্টেমকে বিশেষ ভাবে ক্যান্সার প্রতিরোধী করে তোলে, ফলে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপিকে অনেক ক্ষেত্রে ইমিউনো থেরাপিও বলা হয়। মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপির কার্যকৌশল বিভিন্ন হতে পারে, যেমন- কিছু ক্ষেত্রে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ক্যান্সার কোষকে সরাসরি চিহ্নিত করে, ফলে শরীরের অন্যান্য ইমিউন কোষগুলি নির্দিষ্ট ক্যান্সার কোষকে আক্রমন করে ধ্বংস করে। আবার, কিছু ক্ষেত্রে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি, কেমোথেরাপি এবং রেডিওথেরাপির সময়ে ডেলিভারি ভেহিক্যাল হিসাবে কাজ করে।
কোন কোন ক্যান্সার মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপির সাহায্যে চিকিৎসা করা হয়?
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থারাপি বেশ কিছু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ভালো কাজ করে। যেমন-
- ব্রেন ক্যান্সার
- হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সার
- ব্রেস্ট ক্যান্সার
- ফুসফুসের ক্যান্সার
- পাকস্থলীর ক্যান্সার
- ক্রনিক লিম্ফ্যাটিক লিউকেমিয়া
- হজকিন্স লিম্ফোমা
- নন-হজকিন্স লিম্ফোমা
- মেলানোমা
- প্রস্টেট ক্যান্সার
- কোলোরেক্টাল ক্যান্সার
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি কি এবং তা কোথা থেকে আসে?
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি আসলে গবেষণাগারে তৈরি প্রোটিন, যেটা আমাদের ইমিউন সিস্টেমে থাকা অ্যান্টিবডির মতো আচরন করে। মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ভিন্ন প্রকার হতে পারে, যেমন-
- হিউম্যান মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি– মানুষের শরীরে অবস্থিত প্রোটিন থেকে যদি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তাকে হিউম্যান মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি বলে, এটি লেখার সময়ে শেষে -umab লিখতে হয়।
- মিউরাইন মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি– ইঁদুরের শরীরে থাকা প্রোটিন থেকে মিউরাইন মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। -omab শেষে লিখতে হয়।
- কাইমেরিক মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি– মানুষ ও ইঁদুরের প্রোটিনের মিশ্রণে তৈরি হয় কাইমেরিক মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি। -ximab শেষে লিখতে হয়।
- হিউম্যানাইজড মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি– সাধারনত ইঁদুরের প্রোটিনের সাথে মানুষের প্রোটিনের কিছুটা অংশ জুড়ে নিয়ে হিউম্যানাইজড মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি তৈরি করা হয়। -zumab শেষে লিখতে হয়।
ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষ কিছু মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ঃ
১) ন্যাকেড মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি– ক্যান্সার চিকিৎসায় সর্বাধিক ব্যাবহৃত হয় এই ধরনের মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি। এটি দুই ভাবে কাজ করে,
- মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ক্যান্সার কোষের সাথে যুক্ত হয়ে শরীরের ইমিউন কোষগুলির কাছে ‘মার্কার’ হিসাবে কাজ করে। যেমন-অ্যালেমটুজুম্যাব (Campath®) । এটি ক্রনিক লিম্ফ্যাটিক লিউকেমিয়া কোষের উপরিভাবে থাকা সিডি ৫২ অ্যান্টিজেনের সাথে যুক্ত হয়।
- আবার মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ক্যান্সার কোষের বিভাজন ও মেটাস্ট্যাটিস বন্ধ করতে পারে। এটি অ্যান্টিজেন ক্যারিয়ার হিসাবে কাজ করে। যেমন- ট্রাসটুজুম্যাব বা হারসেপটিন মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি, ব্রেস্ট ক্যান্সার কোষের উপরিভাগে প্রকাশিত হার-২ প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয়। এর ফলে হার-২ সিগনালিং পরিবর্তিত হয়ে ক্যান্সার কোষের বিভাজন ও মেটাস্ট্যাটিস বন্ধ হয়ে যায়।
২) কনজুগেটেড মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি– এদের লেবেলড বা ট্যাগ মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি বলে। সাধারনত, এদের সাথে কোন কেমোথেরাপি ড্রাগ বা রেডিও অ্যাকটিভ কনিকা যুক্ত থাকে। এরা, ডেলিভারি ভেহিক্যাল হিসাবে কাজ করে ড্রাগকে সরাসরি ক্যান্সার কোষে পৌঁছে দেয়। উদাহরন হল-জিভ্যালিন (Ibritumomab tiuxetan)। বি-সেল লিম্ফোমার চিকিৎসায় বি-লিম্ফোসাইটের সিডি-২০ প্রোটিনের সাথে যুক্ত হবার জন্যে বিশেষ রেডিওলেবেলড (Yttrium-90) এবং রিটুকক্সিম্যাব ড্রাগ যুক্ত মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি তৈরি করা হয়। এছাড়া আছে, অ্যাডসেট্রিস (Brentuximab vedotin) যা লিম্ফোসাইটের সিডি-৩০ অ্যান্টিজেনের সাথে যুক্ত হয়। এটি MMAE নামের কেমোথেরাপি ড্রাগের সাথে যুক্ত থাকে।
৩) বাইস্পেসিফিক মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি– এই ক্ষেত্রে দুটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যাবহার করে একসাথে ড্রাগ তৈরি করা হয়, সেটি একসাথে দুটি প্রোটিনের সাথে যুক্ত হতে পারে। যেমন- ব্লিনাটুমোম্যাব (Blincyto)। কিছু লিউকেমিয়ার ক্ষেত্রে এই মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ব্যাবহার করা হয়। ব্লিনাটুমোম্যাব শরীরে পৌঁছে, লিউকেমিক কোষের সিডি-১৯ প্রোটিন ও টি-লিম্ফোসাইটের সিডি-৩ প্রোটিনের সাথে যুক্ত হয় এবং ক্যান্সার কোষকে ইমিউন সিস্টেমের মাধ্যমে ধ্বংস করে।
এছাড়া, ক্যান্সার চিকিৎসায় অন্য যে সব মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির ব্যাবহার আছে, তারা-
- ক্যান্সার কোষের কোষপর্দা নষ্ট করে তাকে ধ্বংস করে।
- টিউমারের চারপাশে বাড়তে থাকা রক্তজালিকার বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
- ম্যাক্রোফাজ, ডেনড্রাইটিক কোষ, নিউট্রোফিল, লিম্ফসাইটকে উদ্দীপিত করে ক্যান্সার কোষের কাছে নিয়ে আসে।
মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি কি?
ক্যান্সারের ধরন ও তার দশা, রোগীর শারীরিক অবস্থা, মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির ডোজ, থেরাপির সময়, ইত্যাদির উপরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্ভর করে।
- ইঞ্জেকশানের সাহায্যে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির ডোজ দেওয়া হয়। সেই জায়গায় চামড়া ফুলতে পারে, লাল হতে পারে, র্যাশ বার হতে পারে।
- শীতভাব, জ্বর, মাথার যন্ত্রণা, বমি, ডায়েরিয়া, ক্লান্তি, পেশীতে ব্যাথা ইত্যদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
- কিছু ক্ষেত্রে অ্যালার্জি হয়।
- চামড়ায়, মুখের ভিতর, গালে, মাড়িতে, গলায় ঘা হতে পারে।
- প্রবল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে ‘ইনফিউশান রিঅ্যাকশান’ অর্থাৎ, ইঞ্জেকশান দেবার সাথে সাথেই অ্যালার্জি হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে হার্টের রোগ যেমন, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওর ইত্যাদি দেখা যায়।
- কোন কোন রোগীর মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির ডোজ নেবার পরে ইনফ্ল্যামেটরি লাং ডিসিস হতে দেখা গেছে।
- কোন ক্ষেত্রে রক্তবাহ থেকে প্রোটিন যুক্ত তরল চারপাশের কোষকলায় ছড়িয়ে পরে। একে ক্যাপিলারি লিক সিনড্রোম বলে। এতে রক্তচাপ কমে যায়, অ্যালার্জি হয় ও কখনো মাল্টি অরগ্যান ফেলিওর হতে পারে।
- মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপির ফলে দেহে অনেক ক্ষেত্রে সাইটোকাইনের পরিমান বেড়ে গিয়ে ‘সাইটোকাইন রিলিস সিনড্রোম’ দেখা দেয়, যা গুরুতর অসুস্থতার সৃষ্টি করে।
- রক্তকণিকার সংখ্যা কমতে থাকে।
- অনেক রোগীর ইন্টারন্যাল হেমারেজ হতেও দেখা যায়।
তথ্যসূত্রঃ
- Scott AM, Allison JP, Wolchok JD. Monoclonal antibodies in cancer therapy. Cancer Immun. 2012;12:14.
- Shuptrine CW, Surana R, Weiner LM. Monoclonal antibodies for the treatment of cancer. Semin Cancer Biol. 2012;22(1):3-13. doi:10.1016/j.semcancer.2011.12.009
- Cruz E, Kayser V. Monoclonal antibody therapy of solid tumors: clinical limitations and novel strategies to enhance treatment efficacy. Biologics. 2019;13:33-51. Published 2019 May 1. doi:10.2147/BTT.S166310
- Weiner GJ. Building better monoclonal antibody-based therapeutics. Nat Rev Cancer. 2015;15(6):361-370. doi:10.1038/nrc3930
- Chames P, Van Regenmortel M, Weiss E, Baty D. Therapeutic antibodies: successes, limitations and hopes for the future. Br J Pharmacol. 2009;157(2):220-233. doi:10.1111/j.1476-5381.2009.00190.x