এপ্রিল 20, 2024

মৃগীরোগঃ চিকিৎসা ও সচেতনতা

Reading Time: 4 minutes

ডঃ শুভময়ব্যানার্জী, পি.এইচ.ডি Neucrad Health Desk http://www.fb.com/neucradhealthbengali Oct 21,2021

মৃগীরোগ একটি স্নায়বিক সমস্যা, যার প্রমান প্রায় ৪০০০ খ্রীষ্টপুর্বাদ্বে প্রাচীন লিপি থেকে পাওয়া যায়। মস্তিষ্কের এই রোগ ছোঁয়াচে নয়, কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে শরীরের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর যে কোন বয়সী, প্রায় পাঁচ লক্ষেরও বেশী মানুষ মৃগীরোগে আক্রান্ত হন। এই রোগ হলে, রোগীর বারংবার খিঁচুনি হতে থাকে যা রোগীর অকালমৃত্যুর কারন হয়ে ওঠে। যা সাধারন মৃত্যুর প্রায় তিনগুন! সময় মতো মৃগীরোগের চিকিৎসা করালে দুই-তৃতীয়াংশ রোগী ভালো হয়ে ওঠেন এবং খিঁচুনি হবার মাত্রা অনেকটা কমে আসে। মৃগীরোগ সম্পর্কে এখনো সাধারন মানুষের ধারনা স্পষ্ট নয়। মৃগীরোগীরা আজও মানুষের অবহেলা ও সামাজিক লজ্জার শিকার হন, তাঁদের ঘরে, রাস্তায় ও কর্মস্থলে যথেষ্ট লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতে হয়। তাই মৃগীরোগ দূরীকরণে চাই আরও সামাজিক সচেতনতা।  

মৃগীরোগের কারন কি?

এখনো কি কারনে মৃগীরোগ হয় তা স্পষ্ট নয়। তবে দেখা গেছে, পরিবেশ, জিনগত সমস্যা, সংক্রমণ, বিপাকক্রিয়া, অনাক্রম্যতা ইত্যাদির যথেষ্ট প্রভাব মৃগীরোগ দেখা দেবার জন্যে দায়ী। এছাড়া-

  • মস্তিষ্কে আঘাত লাগলে
  • জন্মের সময় ওজন খুব কম থাকলে এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেন কম পৌছলে
  • মস্তিষ্কে টিউমার হলে
  • জন্মগত কোন সমস্যা, জেনেটিক রোগে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ব্যাহত হলে
  • স্ট্রোকের ফলে, মস্তিষ্কে কম অক্সিজেন পৌছলে
  • মেনিনজাইটিস ও এনকেফেলাইটিসের প্রবল সংক্রমণের ফলে

মৃগীরোগের উপসর্গগুলি কি কি?

  • মৃগীরোগে থেকে থেকে বারবার খিঁচুনি হয়। দ্রুত, অনিয়ন্ত্রিত হাত-পা সহ দেহের অন্যভাগ কাঁপতে থাকে, এমনকি এর তীব্রতায় রোগী অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। মস্তিষ্কের কিছু কিছু কোষের থেকে অত্যাধিক বৈদ্যুতিক সংকেত পরিবহনের ফলে, এই খিঁচুনি হয়ে থাকে।

এই খিচুনির ঘটনাটি সামান্য সময়ের জন্যে হতে পারে আবার দীর্ঘ সময়ের ব্যাবধানে হতে পারে (বছরে এক বার)। তবে, কোন মানুষের বিশেষ কারন ছাড়া একাধিক বার প্রবল খিঁচুনি হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃগীরোগ বলে অভিহিত করেন।

  • জ্বর ছাড়া খিঁচুনি হতে পারে, সাথে প্রবল ক্লান্তি আসে।
  • দেহের কোন কোন অঙ্গ হঠাৎ শক্ত হয়ে যায়।
  • সাময়িকভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলে, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মল-মূত্র নির্গমন হয়ে গেলে মৃগীরোগ হতে পারে।
  • এই রোগে, অনিশ্চয়তা ও স্মৃতিশক্তির হ্রাস ঘটে।
  • কারন ছাড়া মানসিক বৈকল্য, ক্রোধ, ভয়, মানসিক অবসাদ ত্যাদি হতে পারে।
  • মৃগীরোগীর গন্ধ, স্পর্শ, স্বাদের পরিবর্তন দেখা দেয়।
  • পথে-ঘাটে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ায় অনেকক্ষেত্রে মৃগীরোগীর হাত-পা ভেঙ্গে যেতে পারে, গুরুতর চোট-আঘাত লাগতে পারে।   

মৃগীরোগের প্রকারভেদ কি কি?

মৃগীরোগের খিঁচুনি পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে অনিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিক সংকেত পরিবহনের ফলে হয়ে থাকে বা মস্তিষ্কের কিছু বিশেষ অংশে হতে পারে। এই ঘটনার উপর নির্ভর করে, মৃগীরোগের প্রকারভেদ দেখা যায়।

১) জেনেরেলাইসড এপিলেপ্সি

২) ফোকাল এপিলেপ্সি

৩) কম্বাইনড জেনেরেলাইসড অ্যান্ড ফোকাল এপিলেপ্সি

৪) আননোন এপিলেপ্সি

কিভাবে মৃগীরোগ নির্ণয় করা হয়?

  • চিকিৎসক রোগীর উপসর্গ, চিকিৎসার ইতিহাস, পূর্বে ঘটে যাওয়া কোন খিঁচুনি বা সংজ্ঞাহীনতা ইত্যাদি দেখে এবং কিছু রক্ত পরীক্ষা করে মৃগীরোগ শনাক্ত করেন। এর পরে, রোগীর স্পিচ ও কগনিটিভ ফাংশান পরীক্ষা করে দেখা হয়। স্নায়ুর নানা পরীক্ষার মাধ্যমে, কি ধরনের খিঁচুনি হচ্ছে, তা বোঝা যায়। যে সমস্ত পরীক্ষায় এই গুলি নির্ণয় করা হয়, তা হোল-
  • মস্তিষ্কের অনিয়ন্ত্রিত তরঙ্গ পরিমাপ করতে করা হয় ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম (EEG)।
  • ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স স্পেকট্রোস্কপি (MRS), পজিসন এমিশন টমোগ্রাফি (PET), কম্পিউটারাইজড টোমোগ্রাফি (CT), ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (MRI)- এইগুলির সাহায্যে মস্তিষ্কে কলাকোষের ক্ষয় অথবা টিউমার আছে কিনা বোঝা যায়।
  • সিঙ্গল ফোটন এমিশন সিটি () স্ক্যান করে কোথায় মস্তিষ্কে সিজার হতে পারে তা নির্ণয় করা হয়।
  • মস্তিষ্কের কোন অংশ ঠিকভাবে কাজ করছে না তা ফাংশানাল এমআরআই () করে বোঝা যায়।
  • ম্যাগনেটিক সিগন্যালের পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে, মস্তিষ্কের অনিয়মিত কাজ বোঝা যায় ম্যাগ্নেটোএনসেফালোগ্রাম করে।    

কিভাবে মৃগীরোগ প্রতিরোধ করা যায়?

নিম্নলিখিত উপায়ে এক-তৃতীয়াংশ মৃগীরোগ প্রতিরোধ করা যায়।

  • মস্তিষ্কের চোট-আঘাত লাগার সম্ভাবনা থেকে দূরে থাকতে হবে, এতে পোস্ট-ট্রমাটিক এপিলেপ্সি প্রতিরোধ করা যাবে।
  • জন্মের আগে প্রসূতি ও সন্তানের যত্ন নিতে হবে এছাড়া, জন্মের সময়ে প্রসবকালীন সমস্যা যাতে না হয় তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • অত্যাধিক মদ্যপান, তামাকজাত দ্রব্য সেবন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওবেসিটি ইত্যাদি কমাতে হবে।
  • গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু ড্রাগ শিশুদের জ্বর কমাতে সাহায্য করে, সেই সব ড্রাগ এপিলেপ্সি কমাতে সাহায্য করে।
  • সংক্রমণ কমানো দরকার, বিশেষ করে অন্তঃপরজীবী প্রাণীর। তাহলে কিছুটা মৃগীরোগ প্রতিরোধ হতে পারে। 

মৃগীরোগের চিকিৎসা

আগে আলোচনা করা হয়েছে, মৃগীরোগে প্রবল ব্রেন সিজার হয়ে থাকে, তাই সঠিক সময়ে দ্রুগের সাহায্যে রোগীদের সিজার নিয়ন্ত্রণ করলে প্রায় ৭০% মৃগীরোগ কমানো সম্ভব। বেশীরভাগ অ্যান্টি-সিজার মেডিসিন এখন অনেক কম মূল্যে পাওয়া যায়। একবার এই মেডিসিন নেওয়া শুরু করলে, কেবল মাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, ডোজ পরিমাপ করে এই মেডিসিন বন্ধ করা উচিত (সিজার সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ হবার দুই বছর পর)। তবে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এখনো অ্যান্টি-সিজার মেডিসিন সব সময়ে পাওয়া যায় না, প্রচুর চাহিদা থাকা সত্বেও। এছাড়া, উপযুক্ত জনসচেতনতার অভাবে অনেক রোগী একবার চিকিৎসার পরে আর চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করেন না, ফলে “ট্রিটমেন্ট গ্যাপ” তৈরি হয়। এটি তৈরি হলে পুনরায় রোগী অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে, মেডিসিন কাজ না করলে, মস্তিষ্কের বিশেষ কোন অংশে সার্জারি করে মৃগীরোগ সারানো হয়।     

তথ্যসূত্রঃ

  1. Stafstrom CE, Carmant L. Seizures and epilepsy: an overview for neuroscientists. Cold Spring Harb Perspect Med. 2015;5(6):a022426. Published 2015 Jun 1. doi:10.1101/cshperspect.a022426
  2. Bromfield EB, Cavazos JE, Sirven JI, editors. An Introduction to Epilepsy [Internet]. West Hartford (CT): American Epilepsy Society; 2006. Chapter 2, Clinical Epilepsy. Available from: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK2511/
  3. Anwar H, Khan QU, Nadeem N, Pervaiz I, Ali M, Cheema FF. Epileptic seizures. Discoveries (Craiova). 2020;8(2):e110. Published 2020 Jun 12. doi:10.15190/d.2020.7
  4. Manford M. Recent advances in epilepsy. J Neurol. 2017;264(8):1811-1824. doi:10.1007/s00415-017-8394-2
  5. Bromfield EB, Cavazos JE, Sirven JI, editors. An Introduction to Epilepsy [Internet]. West Hartford (CT): American Epilepsy Society; 2006. Chapter 1, Basic Mechanisms Underlying Seizures and Epilepsy. Available from: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK2510/
  6. Goldenberg MM. Overview of drugs used for epilepsy and seizures: etiology, diagnosis, and treatment. P T. 2010;35(7):392-415.

Blume WT. Diagnosis and management of epilepsy. CMAJ. 2003;168(4):441-448.

গর্ভাবস্থা:বয়সভেদে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য (Pregnancy: Mother and Child’s Health) -ডাঃ অপূর্ব পৈলান
Neucrad Health এর Partner হয়ে ওঠার সুযোগ নিন
ভ্যাকসিন কতদিন কার্যকারী থাকতে পারে?
মা ও শিশুদের জন্য পুষ্টি (Nutrition for Mother and Children) – ডায়েটিশিয়ান ঐশী রায়
(COPD)সিওপিডি ‘র কারণ ও চিকিৎসা  -ডাঃ অনির্বাণ ভৌমিক