এপ্রিল 26, 2024

ঘুম ও স্বাস্থ্য – বিশ্ব ঘুম দিবস উপলক্ষে বিশেষ প্রতিবেদন

Reading Time: 3 minutes

প্রবন্ধটি লিখেছেন ডঃ রমেশ ভুঁইয়া, পিএইচডি এবং অনুবাদে মোনালিসা মোহান্ত

সারা দিনের পরিশ্রমের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত শক্তির পুনরুদ্ধার করে দেহকে পুনরুজ্জীবন দিতে, পর্যাপ্ত ঘুম অত‍্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমাদের শরীরের পেশীর স্বাভাবিক বৃদ্ধি, কোষকলা গুলির মেরামত,ও প্রয়োজনীয় হরমোন গুলির সংশ্লেষ করার জন্য, প্রতিদিন কয়েক ঘন্টার ঘুম দরকার।

‌কেন আমাদের শরীরের ঘুমের প্রয়োজন, তার অনেক কারণ আছে। আমাদের সর্বোত্তম স্বাস্থ্যের জন্য এবং সুস্থ থাকার জন্যই প্রয়োজন। ঘুম সবার জন্যই সমান জরুরি। সার্কিডিয়ান ছন্দ দেহের ইম‍্যিউন সিস্টেমকে কার্যকরী করার জন্য, মনের শান্ত এবং ঘুমচক্র বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এটি আমাদের শরীরের অবকাশ, যা শক্তি অর্জনের মাধ্যমে নিজেকেই মেরামত করে। একটি সার্কডিয়ান তাল হল একটি জৈব প্রক্রিয়া যা প্রায় 24 ঘণ্টার অন্তর, দেহ অভ‍্যন্তরে সময় দোলকের কাজ করে।


কতক্ষন ঘুম আদর্শ?
বিভিন্ন বয়সের লোকেদের ঘুমের চাহিদাগুলি পূরণ করতে বিভিন্ন ঘুমের প্রয়োজন হয়। প্রবীণদের প্রতিদিন 7- 9 ঘণ্টা , বাচ্চাদের 11 থেকে 14 ঘন্টার ঘুম দরকার। স্কুলের বাচ্চাদের জন্য 9 থেকে 11 ঘন্টা বিশ্রাম প্রয়োজন; যখন কৈশরে 8 থেকে 10 ঘণ্টার মধ্যে ঘুম অপরিহার্য। শিক্ষার্থীদের বৃদ্ধির সময়ে, তাদের সর্বোত্তম বৃদ্ধির জন্য ভারী মাত্রার ঘুমের এ প্রয়োজন। পর্যাপ্ত ঘুম দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলা করতে আমাদের মন ও দেহকে প্রস্তুত করে।

মানুষের জীবনে কেন ঘুমের প্রয়োজন?
নিদ্রাও শ্বাসের মতো শরীরের মৌলিক প্রয়োজন। শরীরের হৃদস্পন্দনের হার কমাবাড়া ও একই সাথে রক্ত ​​সঞ্চালনের হ্রাস-বৃদ্ধিও, সার্কডিয়ান তাল বজায় রাখতে দিন / রাত্রি জুড়ে চলতেই থাকে। ঘুম প্রয়োজন প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রে পৃথক। মানুষের ঘুমের প্রয়োজন আজও একটি রহস্য। আমরা আমাদের জীবনের এক তৃতীয়াংশ ঘুমিয়েই কাটিয়ে দি । দীর্ঘ সময় না ঘুমানো এমন মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে,যা অবশেষে মৃত্যুর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। আসলে আমরা খাদ্য ছাড়া বেঁচে থাকতে পারি, কিন্তু ঘুম ছাড়া নয়। বেশ কয়েক দিন না ঘুমালে, ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করতে শুরু করে। যথেষ্ট না ঘুমানোয় প্রথম প্রথম দুর্বলতা, শরীরের ঝাঁকুনি অনুভূত হয় এবং অবশেষে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে শুরু করে।

সঠিক ওজন বজায় ধরে রাখতে ঘুম:-
কম ঘুমালে,আপনি অতিরিক্ত ওজন অর্জন করতে পারেন। কিছু গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে যারা প্রতিদিন 7 ঘন্টা ঘুমাচ্ছে,তাদের ওজন এবং সুস্থ জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে যারা প্রতিদিন সাত ঘণ্টারও কম ঘুমাচ্ছেন তাঁরা বেশি ওজন অর্জন করেছেন, প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং স্থূল হওয়ার প্রবণতা বেশি।

সঠিক ঘুম আপনার সুস্থ যৌন জীবনের সহায়ক:-
যে সমস্ত মানুষ পর্যাপ্ত মানের ঘুমের সময় পান না তাদের যৌনচাহিদা ক্রমশই হ্রাস(উভয় পুরুষ এবং মহিলাদের মধ্যে) পায়। পুরুষদের মধ্যে নিদ্রাহীনতায , ঘুমের সময় শ্বাসকষ্ট ইত্যাদির ফলে যৌনতা হ্রাস পায়। অপর্যাপ্ত ঘুমে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যা যৌনচাহিদা ক্রমশই হ্রাস করে।

হৃদরোগের সম্ভাবনা হ্রাস:
দীর্ঘদিন না ঘুমানো হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে। হাত-পায়ের কাঁপুনির সাথে সাথেই, রক্তচাপ এবং কলেস্টেরল সহ, অন্যান্য রাসায়নিকের মাত্রা (প্রদাহের সাথে সংযুক্ত) বৃদ্ধি করে; যা অতিরিক্ত চাপ বৃদ্ধি করে হৃদয়ের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপকে প্রভাবিত করে। অতএব, হৃদরোগের সম্ভাবনা হ্রাস করতে সঠিক ঘুমের প্রয়োজন।

ঘুম প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে:-
কিছু মহিলার গর্ভধারণের অসুবিধা থাকে, যা ঘুমকমের প্রভাবগুলির মধ্যে একটি হতে পারে, যেহেতু সার্কডিয়ান ছন্দ প্রজনন হরমোন ক্ষরণের নিয়ন্ত্রক ।

সপ্তাহান্তে ঘুমের ঘাটতি পূরণ করতে চেষ্টা করুন:-
ব্যস্ত সময়সূচীর কারণে বেশিরভাগ মানুষই যথেষ্ট ঘুমের সময় পান না, তবে সপ্তাহান্তে ছুটি দিনে অতিরিক্ত কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিন। তাতে ঘুমের ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হবে। ঘুম কাটানোর জন্য স্বল্পমেয়াদী বলবর্ধকপানীয় বা ক্যাফিনের উপর নির্ভর করবেন না, কারণ এটি ঘুমের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।

ভালো ঘুমের জন্য কয়েকটি পরামর্শ:

  • একটি আরামদায়ক বিছানায় ঘুম, আপনার সন্তানের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। একই পদ্ধতিতে এবং একই সময়ে ঘুম, গভীর ঘুম হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়িয়ে দেয়।
  • শোবার সময় রুমে রং আলো বন্ধ করে দিন কিম্বা হাল্কা আলো ব‍্যবহার করুন। কম আলো মেল্টোনিন নামক হরমোন তৈরি করে গভীর ঘুম আনতে সহায়তা করে। শোবার সময় হাল্কাভাবে গান চালানো বা একটি গল্পের বই পড়ার চেষ্টাও তাড়াতাড়ি ঘুম আনতে পারে।
  • প্রতিদিন প্রাণায়াম এবং যোগাভ‍্যাস, শরীরের ফিটনেস ধরে রাখার পাশাপাশি, ভালো ঘুমে সাহায্য করে।
  • বেডরুমের (ঘুমের আগে) টিভি, মোবাইল বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক গ্যাজেট গুলির ব‍্যবহার কম করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
  • শয়নকক্ষে ভাল বায়ুচলাচল এবং 18 থেকে 25 ডিগ্রী সেলসিয়াস এর মধ্যে তাপমাত্রা দ্রুত ঘুমের সহায়ক।

কেন একেকজন সব সময় ক্লান্ত বোধ করে?
নিম্নলিখিত সম্ভাব্য কারণ হতে পারে কিছু হতে পারে।

  • প্রতিদিন অনেক দেরী রাত অবধি জেগে থাকা।
  • কাজের জন্য অতিরিক্ত সময় ধরে ব‍্যস্ত থাকা।
  • মানসিক হতাশার কারণে ক্লান্ত বোধ করা
  • মায়েদের ক্ষেত্রে বাচ্চা শিশুর দেখাশোনা করতে গিয়ে রাত জাগা … ইত্যাদি।

দীর্ঘদিন ক্লান্তি এবং অবসাদে ভুগতে থাকা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এটি জীবনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

ক্লান্তিকর মানসিক কারণ:-
ক্লান্তির মানসিক কারণগুলি দীর্ঘসময় হল কমঘুম বা অনিদ্রা। যার ফলে মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, উদ্বেগ সহ দিনকাল মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ক্লান্তির অন্যান্য কারনগুলো হল:-

  • রক্তাল্পতা।
  • থাইরয়েড।
  • নিদ্রাহীনতা।
  • স্থূলকায় দেহ।
  • প্রয়োজন এর চেয়ে কম ওজন।
  • ক‍্যান্সার।
  • কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়া
  • নির্দিষ্ট ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।

যেহেতু ঘুম অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই সঠিক ঘুমচক্র বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। যদি কেউ চার সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে নিদ্রাহীনতা এবং ক্লান্তি অনুভব করে থাকে তবে সাধারণ চিকিসকের সাথে পরামর্শ করা উচিৎ।

প্রবন্ধটি লিখেছেন ডঃ রমেশ ভুঁইয়া। পিএইচডি ফার্মাকোলজি, ক্লিনিকাল ও মেডিক্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগ; ফার্মাজ্ ইন্ডিয়া প্রাঃ লিঃ,নিউ দিল্লি।