হাইড্রোজেল সুষুন্মাকান্ডের আঘাতের পর শ্বাসক্রিয়া পুনুরাদ্ধারে সাহায্য করে
সূত্র: টমাস জেফারসন ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা
ল্যাব পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে হাইড্রোজেল বাহ্যিক আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত শ্বাস নিয়ন্ত্রণে সাহায্যকারি মেরুদন্ডের স্নায়ুগুলিকে মেরামত করতে পারে, এবং ভবিষ্যতে এটি রোগের চিকিৎসায় ব্যাবহৃত হতে পারে।
গাড়ী দুর্ঘটনা, খেলাধুলা, বা অন্যান্য ঘাড়ের চোট থেকে সুষুন্মাকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যার ফলে শ্বাস নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা লোপ পায় এবং রোগীদের প্রায়শই তাদের বাকি জীবনের জন্য কৃত্রিম বায়ুচলাচলের (ভেন্টিলেশন) সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। জেফারসনের গবেষকরা (ফিলাডেলফিয়া ইউনিভার্সিটি ও থমাস জেফারসন ইউনিভার্সিটির গবেষক) সম্প্রতি ইঁদুরের ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে হাইড্রোজেল স্নায়ুর আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে একপ্রকার স্নায়ু-রক্ষাকারী পদার্থ ছড়িয়ে দেয় এবং ইঁদুরের শ্বাসক্রিয়া পুনরুদ্ধার করে।
জেফারসনের ভিকি অ্যান্ড জ্যাক ফারবার ইন্সটিটিউট ফর নিউরোসায়েন্স-এর গবেষক অ্যাঞ্জেলো লেপোর জানিয়েছেন যে ‘হাইড্রোজেল সুষুন্মাকান্ড মেরামতি করতে পারে এমন এক ধরনের স্নায়ুতন্ত্র-উদ্দীপক পদার্থ সরবরাহ করে অথচ এদের কোনোরকম পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকেনা’। ‘আমরা বিশেষ করে স্নায়ুতন্ত্রের যে অংশ শ্বাসক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে তার পর্যবেক্ষণ করেছি। প্রাণী মডেলে আমাদের এই প্রাথমিক গবেষণা ভবিষ্যতে শ্বাসক্রিয়ার জটিলতায় ভোগা রোগীদের ক্ষেত্রে নতুন চিকিত্সাপদ্ধতির পথ প্রশস্ত করতে পারে এবং আঘাত দ্বারা প্রভাবিত অন্যান্য শারীরিক জটিলতা নিরসনেও অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারে’।
সম্প্রতি এই গবেষণাপত্রটি ‘জার্নাল অফ নিউরোসায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ডঃ লেপোর এবং তাঁর সহকর্মী ড্রেক্সেল ইউনিভার্সিটির ইংহুই ঝং একপ্রকার জেল তৈরি করেছেন যা স্নায়ু-উদ্দীপক পদার্থ ‘বিডিএনএফ’-এর (ব্রেন-ডিরাইভ্ড্ নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর) সঙ্গে যুক্ত হয় এবং আঘাতের জায়গায় এই স্নায়ু-পুনুরুদ্ধারকারী প্রোটিনকে নিয়ে যায়।
এই গবেষণাপত্রের অন্যতম প্রধান সহযোগী গবেষক ডঃ বিশ্বরূপ ঘোষ বলেছেন ‘এই জেল-এ এমন ক্ষমতা আছে যাতে এটি একটি নির্দিষ্ট মাত্রায়, নিয়ন্ত্রিত সময় ধরে ও নির্দিষ্ট জায়গায় প্রোটিনকে নিয়ে যায়, একটি নিরাপদ পদ্ধতিতে সংস্থাপন করা যায় এবং এটি জৈব-সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থাৎ শরীরে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধক্রিয়া গড়ে ওঠে না’।
বিডিএনএফ একটি পরিচিত নার্ভ-গ্রোথ ফ্যাক্টর (স্নায়ু বৃদ্ধিকারক) এবং এটি এএলএস (অ্যামাইওট্রপিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস, এক ধরনের স্নায়ুর রোগ) রোগীদের জন্য পরীক্ষামূলক প্রয়োগগুলিতে যাচাই করা হয়েছে। কিন্তু যখন এটি সমগ্র স্নায়ু এবং রক্তসংবাহনতন্ত্রের মধ্যে সঞ্চালিত হয় তখন এটি পেশীর খিঁচুনী এবং দূরারোগ্য ব্যথা জাতীয় পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যার ফলে ব্যথার অনুভূতি বৃদ্ধি হয় বা যে উদ্দীপনায় সাধারণত ব্যাথার উদ্রেক হয়না তাতেও ব্যথা অনুভূত হয়।
ডাঃ লেপোর বলেন ‘‘শুধুমাত্র আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে সূচিপ্রয়োগ দ্বারা বিডিএনএফ সমৃদ্ধ জেল প্রয়োগের ফলে আমরা এই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া মুক্ত হতে পারি’। যদিও বিভিন্ন ধরনের স্নায়ু মেরুদণ্ডের আঘাত দ্বারা প্রভাবিত হয়, গবেষকরা এক্ষেত্রে বিশেষ করে ফ্রেনিক স্নায়ুর পর্যবেক্ষণ করেছেন যা মধ্যচ্ছদাকে (পেশী যা মূলত ফুসফুসের ছন্দোবদ্ধ প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করে) নিয়ন্ত্রণ করে। গবেষকেরা মেরুদণ্ডের আঘাতের পরে ইঁদুরের মধ্যে বিডিএনএফ-জেল প্রয়োগের পরে মধ্যচ্ছদা-পেশী সংকোচন পরিমাপ করে ওই প্রাণীদের শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণে ৬০-৭০ শতাংশ উন্নতি লক্ষ্য করেছেন। কোষগত পরিবর্তনের দিকে তাকালে, গবেষকরা পর্যবেক্ষণ করেছেন বিডিএনএফ-জেল মস্তিষ্ক-থেকে-মেরুদণ্ড-থেকে-মধ্যচ্ছদা সংযোগটি সুরক্ষিত রাখতে অথবা সংযোগ বজায় রাখতে সাহায্য করে। কখনো দীর্ঘ লম্বা ফ্রেনিক স্নায়ুর (এদের একপ্রান্ত সুষুন্মাকান্ডের সঙ্গে ও অন্য প্রান্ত মধ্যচ্ছদার পেশীর সঙ্গে জুড়ে থাকে) একপ্রান্ত মেরুদন্ডের আঘাতের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের সংযোগবিচ্ছিন্ন হয় এবং অন্যপ্রান্ত শুধুমাত্র মধ্যচ্ছদা পেশীতে আটকে থাকে।
ডাঃ লেপোর ও সহকর্মীরা দেখিয়েছেন যে এই জেল স্নায়ুতন্ত্রের সংযোগ পুনরুদ্ধার করতে অথবা মেরুদন্ডের ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ুর সংযোগচ্ছেদ রোধ করে মেরুদণ্ড-মধ্যচ্ছদা যোগাযোগ বজায় রাখতে সহায়তা করে। অন্য কিছু স্নায়ু মস্তিষ্ক থেকে মেরুদণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে ছন্দোবদ্ধ শ্বসনক্রিয়া চালু ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। এই স্নায়ুগুলিও আঘাতের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ডাঃ লেপোর ও সহকর্মীরা দেখিয়েছেন যে বিডিএনএফ-জেল মস্তিষ্কের ছন্দ-নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রের সঙ্গে মেরুদন্ডের এবং মধ্যচ্ছদা পেশীর সংযোগকারী স্নায়ুগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করে। ডাঃ লেপোর বলেন ‘যদিও মেরুদণ্ডের আঘাতের সময় অন্যান্য ধরনের ক্ষতিও হতে পারে তবুও এটি আশাজনক যে এই জেল শ্বাস-নিয়ন্ত্রণ বিনষ্টকারী দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া রোধ করতে সাহায্য করে’। গবেষকরা এই বায়োজেল প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত সময়সীমা এবং প্রয়োগের মাত্রা অনুসন্ধান করার যাওয়ার কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তারা বিশেষত যেখানে আঘাতের পরে তাত্ক্ষণিক চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া যায় না এমন পরিস্হিতিতে এই জেল কাজ করতে পারে কিনা তার মূল্যায়ণ করবেন। একই সঙ্গে তারা এই পদ্ধতিটি অন্যান্য ধরণের স্নায়ুর সুরক্ষা বা পুনরুদ্ধার ও সেই সঙ্গে রোগীদের শারীরিক কার্যকারিতা বজায় রাখতে সহায়তা করে কিনা তার অন্বেষণেও আগ্রহী।
চিত্র শিরোনাম: ফ্রেনিক স্নায়ু তন্ত্র (ঘন সবুজ) থেকে একটি অ্যাক্সন বের হয়ে মধ্যচ্ছদা পেশীর (কমলা) পত্রাকৃতি অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়। বামদিকে দর্শিত হলুদ অংশে অ্যাক্সন মধ্যচ্ছদা পেশীর সাথে যুক্ত থাকে, অন্যদিকে ডানদিকের ছবিতে হলুদ অংশ নেই, এবং অ্যাক্সনের সঙ্গে মধ্যচ্ছদা পেশীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন। গবেষকরা প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে মেরুদণ্ডের আঘাতের পরে বিডিএনএফ-বায়োজেল প্রয়োগ করা হলে তা স্নায়ুর সাথে মধ্যচ্ছদার সংযোগ বজায় রাখতে সহায়তা করে।
Article reference: Biswarup Ghosh, Zhicheng Wang, Jia Nong, Mark W. Urban, Zhiling Zhang, Victoria A. Trovillion, Megan C. Wright, Yinghui Zhong, Angelo C. Lepore, “Local BDNF delivery to the injured cervical spinal cord using an engineered hydrogel enhances diaphragmatic respiratory function,” The Journal of Neuroscience, DOI:10.1523/JNEUROSCI.3084-17.2018,