এপ্রিল 23, 2024

ভারতে সিজার করে বাচ্চাপ্রসব করার প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে

Photo by Luma Pimentel on Unsplash

Reading Time: 3 minutes

কলমে- স্পূর্থী রমন। অনুবাদ ও অক্ষরদানে-মোনালিসা মহান্ত। নিউক্র‍্যাড হেলথ বাংলার নিজস্ব প্রতিবেদন এপ্রিল 4, 2019
ভারতে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সিজার করে সন্তান প্রসবের হার প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নরম‍্যালি যোনিপথে প্রসব প্রায় একটি বিরল ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যদিও স্বাভাবিকভাবে, গর্ভাবস্থায় কোন জটিলতা দেখা দিলে বা মা এবং শিশুর জীবন বিপন্ন করতে পারে এমন ক্ষেত্রে ডাক্তাররা প্রসবদ্বার দিয়ে প্রসব করাতে মানা করেন। পরিবর্তে, একটি অস্ত্রোপচার করে, সি-সেকশন বা সিজারিয়ান সেকশন করে, জরায়ুটি কেটে প্রসবের পথ প্রশস্ত করা হয়।
এই পদ্ধতিতে প্রসব মানেই হাসপাতালে বেশকিছুদিন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা। আর হাসপাতালে ভর্তি থাকা মানেই দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা আকাশচুম্বী বিল। পরোক্ষে হাসপাতালগুলির মুনাফা অর্জন।
তাহলে অদৃশ্য কোনো কারনে ইচ্ছাকৃতভাবেই কি সি-সেকশন ডেলিভারী করতে বাধ্য করানো হচ্ছে? নাকি সত্যিই এতজনের ক্ষেত্রেই সি-সেকশন করার প্রয়োজন হচ্ছে? এই ধরনের “বৃদ্ধি” কী সমর্থনযোগ্য? ভারতে সিজার করে শিশুর জন্মদানের সংখ্যা, অত্যধিক এবং অপর্যাপ্ত দুইই!

ফ্রান্সের প্যারিস ডেসকার্টেস ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক 2010-2016-এর দশকে ভারতে সিজার করে সন্তান প্রসবের প্রবণতা, আঞ্চলিক বৈচিত্র‍্য এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের ইত্যাদির সাথে সি-সেকশন বৃদ্ধির যোগসূত্র সন্ধান করতে একটি সমীক্ষা চালান।

ভারতে সিজারিয়ান বাচ্চার সংখ্যা প্রতি বছর 17.2%; যা বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থার দ্বারা প্রস্তাবিত 15% থ্রেশহোল্ডের তুলনায় সামান্য হলেও বেশি। এই কারনেই ক্রমশ বাড়ছে প্রসবকালীন মা ও নবজাতক এর মৃত্যুহার বাড়ছে। বর্তমানে এই গবেষণার ফলাফল ‘জ্যামা (JAMA) নেটওয়ার্ক ওপেন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণার গবেষকরা 2015 থেকে 2016 সালের মধ্যে জাতীয় পরিবার ও স্বাস্থ্য দপ্তরের করা সার্ভের চতুর্থ রাউন্ড থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। এই তথ্য সংগ্রহ করতে তাদের সাহায্য করেছে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সেস, মুম্বাই। জরিপের সময়, 15 থেকে 49 বছর বয়সের 699,686 কিশোরী এবং মহিলাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল এবং জানুয়ারী 2010 এর মধ্যে তাদের শেষ তিনটি গর্ভাবস্থার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে, ডেটাসেটের প্রায় 259,627 জন্মের তথ্য ছিল।

1980 এর দশকের শেষের দিকে, বিভিন্ন জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সার্ভের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেই সময় কিন্ত ভারতে সিজারিয়ান জন্মের সংখ্যা খুবই কম ছিল। বিগত দশকে, চিকিৎসা তত্ত্বাবধান ছাড়া বাড়িতে প্রসব করানো কমের সাথে সাথেই সমানুপাতে সিজারের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
‘জননি সুরক্ষা যোজনা’ এবং ‘জননি শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমের’ মতো প্রোগ্রামগুলি জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে বিনামূল্যে প্রসবকালীন ও জন্মোত্তর যত্ন নিতে মহিলাদের উৎসাহিত করে এবং বিভিন্ন আধুনিক সুযোগ-সুবিধাও প্রদান করেছে। ফলস্বরূপ, হাসপাতালে ২010-2016 সালে, বার্ষিক 78.9% শিশুর জন্মের তথ্য রেকর্ড করা হয়েছিল।

বর্তমান গবেষণায় দেখা গেছে যে সামগ্রিক সিজারের সংখ্যা 17.2% (বার্ষিক) হলেও, এত সংখ্যক বৃদ্ধির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে অপ্রয়োজনীয় ভাবে সিজার করা হয়েছে।

গবেষকরা জানিয়েছেন, “উদ্ভূত পরিস্থিতিটি উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক ও যৌন বৈষম্যকেও নির্দেশ করে; যার জন্যে অবহেলিত জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে সিজার করানোর প্রবণতা কম হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর মধ্যে প্রতি বছর প্রায় দুই মিলিয়ন অতিরিক্ত সিজারিয়ান বেবির জন্ম হয়।”

ফলাফল থেকে এও দেখা গেছে যে 2013-2016 সালের মধ্যে সি-সেকশন করে বছরে প্রায় 4.38 মিলিয়ন প্রসব করানো হয়েছিল। মাতৃত্বকালীন যত্ন নেবার জন্য নানা সরকারী কর্মসূচির চালুকরা সত্ত্বেও, বিহার ও উত্তর প্রদেশে প্রায় 30% প্রসব বাড়িতে, চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান ছাড়াই করানো হয়েছে।
আবার অপরদিকে, দক্ষিণ ভারতে, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবের য়তো সমৃদ্ধ রাজ্যগুলোতে, প্রায় 90% প্রসব-ই প্রাতিষ্ঠানিক ছিল, অর্থাৎ তারা প্রসবের জন্য মহিলাদের হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।রাজস্থানের অনুন্নত জেলাগুলোতে, বিহার, ঝাড়খণ্ডে সিজারের সংখ্যা প্রায় 10% কম ছিল। যেখানে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন উন্নত রাজ‍্যগুলিতে বার্ষিক সিজারের সংখ্যা 15%।
গবেষকরা দেশের মোট 640 টি জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেন এবং দেখেন যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ভারত, উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড় ও ওড়িশা, পাহাড় বা বনভূমির অঞ্চলে সিজারের সংখ্যা প্রায় 10%কম। অন্যদিকে, দক্ষিণ ভারতে সিজারের সংখ্যা 35% , তেলেঙ্গানাতে সিজারের হার সর্বোচ্চ প্রায় 57.7%।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, আর্থ-সামাজিক বৈষম্যও সিজারের হার কমবেশি সবার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজের দরিদ্র অংশগুলিতে যেখানে সিজারের হার মাত্র 4.4% , সেখানে সমৃদ্ধ জনপদ গুলিতে বেড়ে 40% পর্যন্ত পৌঁছেছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, “অনুন্নত জনগোষ্ঠীগুলিতে সি-সেকশন‌ করে জন্মদান মোট জন্মদানের 10%; যেখানে উন্নত জনগোষ্ঠীর মোট প্রসবের 20% এরও বেশি সিজার।
“বিভিন্ন সরকারি সাহায্য প্রদানের পর 2015-16 সালে, এই হার বেড়ে 26.5% থেকে 40.8% এ পৌঁছেছে।

তবে সবথেকে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো সরকার থেকে মাতৃত্বকালীন বা প্রসবকালীন এত সুযোগ সুবিধাও পরেও কিন্তু একটি বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী হসপিটালে বা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রসব করাতে পারেন না কেবলমাত্র আর্থিক দুর্বলতার কারণ। যাই হোক তাছাড়াও ভারতবর্ষে সি-সেকশন‌ করে প্রসাব করানোয় রেকর্ড করে ফেলেছে। 2010-16 এর মধ্যে প্রায় 1.8 মিলিয়ন অতিরিক্ত সিজার করা হয়েছে ভারতে! বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গুলিতে এইভাবে জন্ম দেওয়ার বা প্রসব করানোর হার‌ সবথেকে বেশি।
আবার একইসাথে এই সময়ের মধ্যে কিন্তু অন্য জায়গা গুলিতে বা অনুন্নত জনগোষ্ঠীগুলিতে সিজারের হার 0.5 মিলিয়ন কম হয়।

সিজার করে জন্মেদান করা মানে কী স্বাস্থ্যকর মা এবং শিশু? মোটেই না। গবেষকরা জানিয়েছেন এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। বরং, অনেকক্ষেত্রেই সিজার করে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মা ও শিশুর মৃত্যু হয়।

ভারতের যে হারে প্রসবকালীন সুযোগ-সুবিধা ও স্বাস্থ্য সুবিধা দেয়া হচ্ছে, তাতে মনে করা হচ্ছে মোটামুটি দুই হাজার কুড়ি সালের মধ্যেই সমস্ত মহিলা হাসপাতালের বা কোন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রসব করাবেন।
একদিকে এটি সুসমাচার হলেও, সি-সেকশন করানোর প্রবনতা বৃদ্ধি উদ্বেগের কারণ। এই ধরনের অবাঞ্ছিত বৃদ্ধি আসল উদ্দেশ্য কারণ হচ্ছে তা খুঁজে বের করাটা কিন্তু অত্যন্ত জরুরী তবে আমরা এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে পারবো।

শহুরে এলাকায় এবং মধ্যবিত্তের মধ্যে, সিজার করানোর হারগুলি ইতিমধ্যে অত‍্যধিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। নারী ও স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের উপর নজরদারি করতে হবে এবং সাথে সাথে চিকিৎসকদের মধ্যেও সচেতনতা বাড়াতে হবে বা বার্তা পৌঁছাতে হবে যাতে তারাও অপ্রয়োজনে কোন সিজার না করে। তবেই ভারতে এই ধরনের সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব হবে বলে দাবি করেছেন গবেষকরা।