স্পুটনিক V ভ্যাকসিন – বিজ্ঞান ও ফেজ ৩ ক্লিনিকাল গবেষণা রিপোর্ট
শুভময় ব্যানার্জী, পিএইচডি, নিউক্র্যাড হেলথ এর প্রতিবেদন, ফেব্রূয়ারি ৯, ২০২১
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে রাশিয়ার স্পুটনিক V নামের ভ্যাকসিন হিউম্যান ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ফেজ-III এর শেষে প্রায় ৯২% কার্যকারিতা দেখিয়েছে। ল্যান্সেট পত্রিকায় এই গবেষণার কথা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে এই ভ্যাকসিন করোনা রোগীদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে যথেষ্ট কার্যকরী।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গতবছর আগষ্ট মাসেই এই ভ্যাকসিন বার হবার সাথে সাথে যথেষ্ট সমালোচনার মুখে পড়ে। সেই সময়ে ভ্যাকসিনটিকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ফেজ-III এর ফলাফল ছাড়াই জনগণের উপরে প্ৰয়োগ করার অনুমোদন দেওয়া হয়। যাই হোক, সম্প্রতি গবেষণাপত্রে ভ্যাকসিনটির শেষ পর্যায়ের ফল প্রকাশের সাথে সেটি ফাইজার, অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, জানসেন ইত্যাদি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলির সাথে সমমর্যাদার স্থানে পৌঁছলো।
স্পুটনিক V ভ্যাকসিন কাজ করার ভিন্ন পদ্ধতি:
এই ভ্যাকসিনে ব্যবহার করা হয়েছে অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টর। নিরাপদ ভ্যাকসিন তৈরীর ক্ষেত্রে অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টরের ব্যবহার বহুল প্রচলিত। এখনো পর্যন্ত প্রায় আড়াইশোর বেশী ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এর যথাযত ব্যবহার হয়েছে। অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টর জৈব-প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরী জেনেটিক্যালি মডিফায়েড ভাইরাস যা মানুষের শরীরে বংশবিস্তার করতে পারে না।
এই স্পুটনিক V অক্সফোর্ড/অ্যাস্ট্রাজেনেকার (ব্রিটেনে তৈরী) আর জানসেনের (বেলজিয়ামে তৈরী) ভ্যাকসিনের মতোই অ্যাডেনোভাইরাস ভেক্টরের সাহায্যে তৈরী। নভেল করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সিকোয়েন্স ব্যবহার করে স্পুটনিক V তৈরী হয়েছে। এই ভ্যাকসিন শরীরে প্ৰয়োগ করলে সংক্রমণের কোন ভয় নেই। এটি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরী করতে সক্ষম। ফলে মানুষ নভেল করোনাভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হলে এই স্পুটনিক V তাকে সফলতার সাথে প্রতিরোধ করতে পারবে বলেই বিজ্ঞানীদের অভিমত।
অন্যান্য ভ্যাকসিনগুলির চেয়ে এটি আলাদা, কারণ এতে দুটি ভিন্ন প্রকার অ্যাডেনোভাইরাস সেরোটাইপের ব্যবহার হয়েছে।
- প্রথম ভ্যাকসিন ডোজে দেওয়া হয় অ্যাডেনোভাইরাস 26 বা Ad26 সেরোটাইপ।
- দ্বিতীয় ডোজে দেওয়া হয় অ্যাডেনোভাইরাস 5 বা Ad5 সেরোটাইপ।
দুই ধরণের সেরোটাইপ ব্যবহারে একটি অভিনব ব্যাপার হয়, প্রথমত: শরীরে আগে কোন অ্যাডেনোভাইরাস বিরুদ্ধে ইমিউনিটি থাকলে তা কমে যায় আর দ্বিতীয়ত: কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে অনেক বেশী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হয়। স্পুটনিক V এর দুটি ডোজ ২১ দিনের ব্যবধানে দেওয়া হয়। আর একটি সুবিধা হলো, এই ভ্যাকসিন ২-৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় ফলে ভ্যাকসিন পরিবহনের ক্ষেত্রে কোন জটিলতার সৃষ্টি হয় না।
স্পুটনিক V এর ফেজ-III ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বিবরণ:
স্পুটনিক V এর তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল গত বছর ৭ই সেপ্টেম্বর থেকে ২৪শে নভেম্বর পর্যন্ত চলে। এই ট্রায়ালে মোট ২০,০০০ ভলেন্টিয়ার অংশগ্রহণ করেছিলো। মূলত মস্কোতে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অনুমোদিত ২৫টি কেন্দ্রে এই ট্রায়াল চালানো হয়। ট্রায়ালে ১৫,০০০ মানুষকে স্পুটনিক V দেওয়া হয় আর বাকিদের প্লাসিবো কন্ট্রোল গ্ৰুপে রাখা হয়। ২১ দিন পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, স্পুটনিক V দেওয়া গ্ৰুপে ১৬ জন এবং প্লাসিবো গ্ৰুপে মোট ৬২ জন কোভিড-১৯ পসিটিভ অর্থাৎ, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রায় ৯১.৬%।
মজার কথা, দ্বিতীয় ডোজের পর ভ্যাকসিনটি রোগের প্রকোপ প্রায় ১০০% কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ভ্যাকসিনটির সেরকম কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। সম্প্রতি ভ্যাকসিনটি বিশ্বের ১৬টি দেশে ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে যেমন তাদের মধ্যে হাঙ্গেরি, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, প্যালেস্টাইন, সৌদি আরব, ইরান ইত্যাদি আছে।
আরও বহু মানুষকে নিয়ে ভ্যাকসিনটির এখনো ট্রায়াল চলার কথা হচ্ছে, যেখানে প্রায় ৪০,০০০ ভলেন্টিয়ারকে ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া হবে। এখনো লান্সেটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই ভ্যাকসিন রাশিয়ার এক-তৃতীয়াংশ মানুষের কাছে পৌঁছেছে।
নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে অন্যান্য ভ্যাকসিনের সাথে সামিল হয়েছে স্পুটনিক V। এই ভ্যাকসিনের ডোজ এখনো পর্যন্ত খুব বেশী তৈরী করা হয়নি, তবে ল্যান্সেটের রিপোর্ট পড়ে বিজ্ঞানী ইয়ান জোন্স ও পলি রয় জানিয়েছেন স্পুটনিক V এর প্রথম ডোজেই সমস্ত বয়সের মানুষের মধ্যে করোনা জনিত রোগের প্রকোপ অনেকটা কমে গেছে, ফলে আশা করা যায় এটি অতিমারী প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। তবে, গবেষণায় বলা আছে, এই ভ্যাকসিন যাদের মধ্যে রোগ উপসর্গ দেখা দিয়েছে তাদের উপর প্রয়োগে ভালো ফল দিয়েছে। এখন যাদের মধ্যে উপসর্গ প্রকাশ পায় নি অর্থাৎ যারা অ্যাসিম্পটোম্যাটিক তাদের ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিন কিভাবে কাজ করবে তা পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।
তথ্যসূত্রঃ
- https://sputnikvaccine.com/
- Calina D, Docea AO, Petrakis D, Egorov AM, Ishmukhametov AA, Gabibov AG, Shtilman MI, Kostoff R, Carvalho F, Vinceti M, Spandidos DA, Tsatsakis A. Towards effective COVID‑19 vaccines: Updates, perspectives and challenges (Review). Int J Mol Med. 2020 Jul;46(1):3-16. doi: 10.3892/ijmm.2020.4596. Epub 2020 May 6. PMID: 32377694; PMCID: PMC7255458.
- https://www.bbc.com/news/world-europe-55198166
- Bucci E, Andreev K, Björkman A, et al. Safety and efficacy of the Russian COVID-19 vaccine: more information needed. Lancet. 2020;396(10256):e53. doi:10.1016/S0140-6736(20)31960-7
- https://www.thelancet.com/journals/lanres/article/PIIS2213-2600(20)30402-1/fulltext