কোভাক্সিন ও কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে জেনে নেওয়া দরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
শুভময় ব্যানার্জী, পিএইচডি, নিউক্র্যাড হেলথ এর প্রতিবেদন, ফেব্রূয়ারি ১, ২০২১
কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সম্প্রতি ভারতে অনুমোদিত হয়েছে দুটি ভ্যাকসিন (কোভাক্সিন ও কোভিশিল্ড)। সাথে সাথে ভ্যাসিনেশান বা টীকাকরনের কাজও শুরু হয়েছে। দুটি ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেই মোট দুটি ডোজ চার সপ্তাহ অন্তর ইন্ট্রামাসকিউলার ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এখনো পর্যন্ত ৭,৭০৪টি টীকাকরন কর্মসূচীতে মোট ৩,৮১,৩০৫ জন মানুষকে এই ভ্যাকসিনগুলি দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হোল, টীকাকরন কর্মসূচীর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৫৮০ জন মানুষের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনেশানের বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই বিরূপ প্রতিক্রিয়াগুলিকে ‘অ্যাডভার্স এফেক্ট ফলোইং ইমিউনাইজেশান (AEFI)’ বলা হয়। এই প্রতিক্রিয়ার উপসর্গ হোল- জ্বর, মাথার যন্ত্রণা, বমি ভাব ইত্যাদি।
কোভিশিল্ড আর কোভাক্সিন দুটি ভ্যাকসিনই বিশেষ ক্ষেত্রে ‘চিকিৎসাকালীন জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে’ প্রয়োগ করার অনুমোদন লাভ করেছে। কিন্তু, কোভাক্সিনের ক্ষেত্রে, হিউম্যান ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার ফল এখনো পাওয়া যায় নি, ফলে এই অনুমোদন অনেকটা ভ্যাকসিনের ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল মোড’ অনুযায়ী টীকাকরনের জন্যে পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীদের চিন্তা আরও বাড়িয়েছে সংবাদসূত্র অনুযায়ী পাওয়া কিছু খবরে। সেটি হোল, টীকা নেওয়ার পরে ভারতের কিছু স্থান থেকে মানুষের মৃত্যুর খবর এসেছে। বিষয়টি বিতর্কিত, কারন ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্যেই এই সব মৃত্যু কিনা তা এখনো পরিস্কার নয়। এই অবস্থায়, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন সমস্ত ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের স্বাস্থ্যের উপর নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
কোভাক্সিন আর কোভিশিল্ডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াঃ
কোভাক্সিন:হাতের যে স্থানে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, সেখানে লালচে ভাব, ব্যাথা, চুলকানি, ফুলে ওঠা ইত্যাদি হতে পারে। কখনো কখনো সেই হাত শক্ত হয়ে যায় এবং শ্রান্তি অনুভূত হয়। এছাড়া, ভ্যাকসিন দেবার পর জ্বর আসতে পারে, শরীরে ব্যাথা হতে পারে, মাথার যন্ত্রণা, বমি, গায়ে র্যাশ বার হতে পারে। যদি, ভ্যাকসিন গ্রহীতার কোন অ্যালার্জির সমস্যা থাকে, তবে তা সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে জানাতে হবে। কারন, সেই অবস্থায় ভ্যাকসিন নিলে প্রচণ্ড অ্যালার্জির বিক্রিয়ায় (Allargic Reactions) শ্বাসকষ্ট, মুখ, জিভ ও গলার শ্বাসনালী ফুলে ওঠা, দ্রুত হৃদস্পন্দন ইত্যাদি প্রানসংশয়কারী উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
কোভিশিল্ড: পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে ক্লান্তি, শরীরে ব্যাথা, ভ্যাকসিন দেওয়ার স্থানে, লালচে ভাব, চুলকানি, ফুলে ওঠা, জ্বর, মাথার যন্ত্রণা, অস্থি-বন্ধনীতে, পেশিতে ব্যাথা, বমি, শীতভাব, সর্দিকাশি, গলায় ঘা, ঘুম ভাব, অতিরিক্ত ঘাম, শরীরে র্যাশ, লিম্ফোঅ্যাডেনোপ্যাথি ইত্যাদি দেখা যায়। ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের কঠোর ভাবে নির্দেশ দেওয়া আছে, শরীরে কোন পূর্ববর্তী অ্যালার্জি (খাবার, ড্রাগ ও ভ্যাকসিনের জন্যে), রোগ ইত্যাদি থাকলে চিকিৎসককে অবিলম্বে জানাতে হবে।
কাদের কোভাক্সিন আর কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত নয়ঃ
কোভাক্সিন: কোম্পানির থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোভাক্সিন নেওয়া একেবারে উচিত নয়। যেমন-
১) কারোর অ্যালার্জি, জ্বর এবং রক্তক্ষরণ জনিত রোগজটিলতা থাকলে, ইমিউনিটি দুর্বল হলে বা ইমিউনিটি কম করার কোন ড্রাগ ব্যাবহার করলে।
২) গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মায়েদের ক্ষেত্রে।
৩) অন্য কোন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিলে।
৪) ভ্যাকসিনেশানের সময়ে অন্য কোন জটিল রোগ ধরা পড়লে।
তবে ভারত বায়োটেক জানিয়েছে, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলে, ভ্যাকসিন গ্রহীতার সরকারী হাস্পাতাল/স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যথোপযুক্ত চিকিৎসা হবে। এছাড়া, প্রতিক্রিয়া জনিত অসুস্থতার ক্ষতিপূরণ ভ্যাকসিন স্পনসর (BBIL) বহন করবে, যদি প্রমান হয় শুধুমাত্র ভ্যাকসিন দেবার জন্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
কোভিশিল্ড: যাদের কোভিশিল্ড নেওয়া উচিত নয়, তারা হলেন-
১) অ্যালার্জি ও পূর্বে ভ্যাকসিন ডোজ নেওয়া থাকলে।
২) কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনে কিছু বিশেষ রাসায়নিক আছে, যেমন- হিসটিডাইন, এল-হিসটিডাইন হাইড্রোক্লোরাইড মনো হাইড্রেট, ম্যাগনেশিয়াম ক্লোরাইড হেক্সাহাইড্রেট, পলিসরবেট ৮০, এথানল, সুক্রোজ, সোডিয়াম ক্লোরাইড, ডাই-সোডিয়াম ইডেটেড ডাই-হাইড্রেট ইত্যাদি। এদের কোন একটিতে অ্যালার্জি থাকলে ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে না।
৩) গর্ভবতী মায়েরা ভ্যাকসিন নিতে পারবেন না।
এই প্রসঙ্গে, ইউরোপের বিখ্যাত চিকিৎসক এবং এপিডেমিওলজিস্ট ডঃ জাম্মি নাগরাজ রাও জানিয়েছেন, অনেক বেশী মানুষকে নিয়ে করা তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের থেকে ধারনা করা যায়, কোন ভ্যাকসিনের কত বেশী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এই ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানীরা সাধারন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা লাভ করেন। অর্থাৎ, যাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, তাদের সমস্ত তথ্য ভ্যাকসিন কর্মসূচীর চিকিৎসকের বা মেডিক্যাল অফিসারের কাছে দেওয়া উচিত এবং কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সঙ্গে সঙ্গে তাদের সাথে যোগাযোগ করা উচিত। অবশ্যই কোন মানুষের নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন হওয়া উচিত এবং শরীরের সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তবেই ভারতে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন গ্রহন করা উচিত।
তথ্যসূত্রঃ
- Bhuyan A. India begins COVID-19 vaccination amid trial allegations. Lancet. 2021;397(10271):264. doi:10.1016/S0140-6736(21)00145-8
- https://vaccine.icmr.org.in/covid-19-vaccine
- https://www.bharatbiotech.com/covaxin.html
- https://www.bbc.com/news/world-asia-india-55632782
- https://science.thewire.in/health/bharat-biotech-serum-institute-covaxin-covishield-fact-sheets-benefits-and-risks/
- https://www.bmj.com/content/372/bmj.n196