3রা মার্চ, বিশ্বজুড়ে পালিত হল ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ডে’-
কলমে- বিজ্ঞেশ কমথ, অনুবাদে- মোনালিসা মহান্ত
পৃথিবীর পৃষ্ঠের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি জল, যার মধ্যে প্রায় 97% সমুদ্র। আর এই মহাসাগরগুলিই, বিভিন্ন আশ্চর্যজনক সব প্রাণীর আবাসস্থল। পৃথিবীর অক্সিজেনের বেশিরভাগই উৎপাদন করে এমন আনুবিক্ষনীক ফাইটপ্ল্যাঙ্কটন যেমন থাকে; তেমনি প্রাননাশী, বৃহদাকার, রাক্ষুসে তিমির ও বিচরনক্ষেত্র এই সমুদ্র। আমাদের গ্রহের বিভিন্ন বন্যপ্রাণী সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর 3 ই মার্চ, বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী দিবস উদযাপন করা হয়। ২019 সালের জন্য থিমটি “জলের নীচে জীবন: মানুষের এবং গ্রহের জন্য” যা জাতিসংঘের 14 স্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের লক্ষ্যমাত্রার সাথে যুক্ত। যেমন , এর লক্ষ্য হল মহাসাগর, সমুদ্র এবং সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ ও স্থায়ীভাবে ব্যবহার করা।
ভারতের 7,517 কিমি সমুদ্র উপকূল রয়েছে। ভারত উপদ্বীপীয় অংশটি পশ্চিমে আরব সাগর, পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগর এবং দক্ষিণে ভারতীয় মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত। যেখানে প্রবালদ্বীপ, ম্যানগ্রোভ এবং সমুদ্র খাঁড়ির মতো বিভিন্ন অনন্য জীববৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র গড়ে উঠেছে। বঙ্গোপসাগরের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জগুলিতে ভারতের প্রধান প্রধান প্রবালপ্রাচীরগুলি রয়েছে। এছাড়াও এই দ্বীপপুঞ্জগুলি, ‘ডুগং’ প্রজাতির প্রাণী দের আবাসস্থল এবং কচ্ছপের প্রজনন স্থান।
ভারতের ওড়িশা উপকূল অলিভ রিডল কচ্ছপগুলির জন্য, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রজনন স্থান। প্রতি বছর, লক্ষ লক্ষ অলিভ রিডল, ডিম পাড়ার জন্য ওড়িশা উপকূলে এসে উপস্থিত হয়। ভারতীয় জলের আরো কিছু সহজাত দক্ষতা সম্পন্ন সামুদ্রিক প্রজাতি হল- লেদারব্যাক সমুদ্র কচ্ছপ, টাইগার শার্ক , তিমি , নীল তিমি এবং ব্রাইডের তিমি ইত্যাদি।
খাদ্য, অপরিশোধিত তেল এবং খনিজগুলির মতো বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ (যেমন লবণ, ম্যাগানিজ এবং নিকেল), মহাসাগর দ্বারাই আমদানি-রপ্তানি করা হয়, যা দেশের অর্থনীতি, খাদ্য ও সংস্কৃতির উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করে। যাইহোক, সাম্প্রতিককালে, অনেক কারণে সারা বিশ্বের মহাসাগুলির অবনতি ঘটেছে। বিশ্বব্যাপী, মহাসাগরের ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক দূষণ একটি উদ্বেগের বিষয়।
২018 সালের নভেম্বরে, ইন্দোনেশিয়ায় একটি তিমি, 6 কেজি প্লাস্টিক পেটে চলে যাওয়ায় মারা গিয়েছিল। কানাডিয়ান বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি, উত্তর মেরুর পাখিদের ডিমগুলিতে প্লাস্টিক দূষণকারীর উপস্থিতি খোঁজ পেয়েছেন। এমনকি পৃথিবীর গভীরতম বিন্দু, মারিয়ানা ট্রেঞ্চে পর্যন্ত, চমকপ্রদ পরিমাণে প্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
জীববিজ্ঞানী অভিষেক জামালাবাদ, ভারতীয় সমুদ্রের প্লাস্টিক বর্জ্য সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে জানালেন-
“আমাদের জলের মধ্যে প্রচুর প্লাস্টিক আছে; সমুদ্রের যে অংশগুলি পরিস্কার করা হয়েছে, সেখান থেকে পাওয়া প্লাস্টিকের পরিমাণ এবং জালে প্লাস্টিক উঠে আসার অভিযোগকারী মাৎসজীবীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা থেকে এর সত্যতা সহজেই বোঝা যাচ্ছে”।
Overexploited মাছ স্টক
শত শত বছর ধরে ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের জন্য মাছ ধরা একটি গুরুত্বপূর্ণ পেশা। বড় টানাজালে মাছ ধরার সময় এক বা একাধিক নৌকা ব্যবহার করে সমুদ্রের জুড়ে জাল টেনে আনা হয় এবং ডিনামাইট ব্যবহার মাছ ধরার ফলে মাছের পরিমাণ ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। এমন অনিয়ন্ত্রিত মৎস শিকারের ফলে, কিছু প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে যেতে চলেছে। প্রায়ই মাছ ধরার সময় জলে আটকা পড়ে পড়ে- কচ্ছপ, ডলফিন, সাগর সাপ, হাঙ্গরগুলির মতো দুর্বল প্রজাতিগুলি শেষ হয়ে যাচ্ছে।
“সমস্ত উপকূলীয় রাজ্যেই – মাছ ধরার নীতি সংরক্ষণ, পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করা উচিৎ। মৎস্য বিভাগ প্রধানত কল্যাণ বিভাগ হিসাবে কাজ করে, নিয়ন্ত্রক হিসেবে এর ভূমিকা সীমিত। গত পাঁচ দশকের তথ্য থেকে দেখানো হয়েছে যে, মাছ ধরার প্রচেষ্টায় উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও মাছ ধরার জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি করার পরে, মাছের সংখ্যা আর হ্রাস পাচ্ছে না।
সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী এবং মৎস্যজীবীদের বাস্তুতন্ত্র পদ্ধতি ও মাছের সংখ্যা হ্রাসের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা দরকার।”- বলেছেন ডঃ মহাবলেশ্বর হেগ্ নামের এক সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী। তিনি নমঃতি নামের একটি সংগঠনের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার।
নির্বিচারে মাছ ধরার সম্ভাব্য সমাধান সম্পর্কে “দক্ষিণ-ফাউন্ডেশনে”র, জীববৈচিত্র্য ও রিসোর্স মনিটরিং প্রোগ্রামের ফিল্ড ডিরেক্টর মুরিলধরন এম বলেন, ” আমাদের ক্ষুদ্রতর / কারিগরি মাছ ধরার অনুশীলনগুলিকে সমর্থন করতে হবে। মৎসজীবীদিদের এই ভাবে মাছ ধরার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। তবেই ধীরে ধীরে, একসাথে প্রচুর মাছ ধরা (শিল্প ভিত্তিক) কম করা যাবে। “
আমাদের উপকূলে বৈচিত্র্যময় সামুদ্রিক জীবন এবং সেখানের মানুষদের কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়; সে সম্পর্কে সচেতনতা বিস্তারের প্রচেষ্টায়, ডঃ জামালাবাদ মুম্বাইয়ের সমুদ্র সৈকতগুলির তীরে নিয়মিত হাঁটার একটি স্বেচ্ছাসেবী-চালিত উদ্যোগ চালু করেছিলেন, যা বাস্তবায়নের জন্য মেরিন লাইফ অফ মুম্বাই (এমএলওএম) সহযোগিতা করেছিল। আরো মানুষকে যোগদানের জন্য উৎসাহিত করার পাশাপাশি, তারা বিভিন্ন সমুদ্রের প্রজাতির তথ্য অন্বেষণ ও সংগ্রহ করে এবং এই তথ্যগুলো iNaturalistনখমের একটি মুক্ত জীববৈচিত্র্য ডাটাবেসে আপলোড ও করে।
জামালাবাদ বলেন, “আমরা মুম্বাইয়ের আন্তঃ জীববৈচিত্র্যের একটি সংগ্রহস্থল গড়ে তুলেছি। বর্তমানে 284 টি প্রজাতির 1300 ট পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, এছাড়াও কিছু অজ্ঞাত প্রজাতিও আছে। এবং আমরা এখনও উপকূলের যাবার সময়, নতুন প্রজাতির সন্ধান করে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টায় রয়েছি।”
এখন, কিভাবে একটি ব্যক্তি মহাসাগর সংরক্ষণে অংশ গ্রহণ করতে পারেন?
আপনি সমুদ্রের কাছাকাছি বাস করেন বা না করেন, এই বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী দিবসে আপনি সামুদ্রিক সংরক্ষণে অবদান রাখতে পারেন এমন কিছু উপায় এখানে উল্লেখ করা হয়েছে:-
প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার কমানো:
কিভাবে প্লাস্টিক মহাসাগর গিয়ে পৌঁচ্ছছে? যাত্রাটি আমাদের বাড়ি থেকেই শুরু। বাড়ির ফেলে দেওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া প্লাস্টিক বর্জ্যগুলি নদীনালা, ল্যান্ডফিল হয়ে অবশেষে মহাসাগরগুলিতেই গিয়ে পৌঁছায়। মহাসাগরগুলি সংরক্ষণ করতে আপনি যে সবচেয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেন, তা হল একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকদ্রব্য ( যেমন-স্ট্র, বোতল, প্যাকেট ইত্যাদি) ত্যাগ করে এবং পরিবেশ বান্ধব বিকল্প ব্যবহার করুন।
সঠিক সামুদ্রিক খাবার পছন্দ করুন:
যখনই সম্ভব, সুপারমার্কেটের পরিবর্তে স্থানীয় বাজার থেকে মাছ কিনুন। উপরন্তু, যে সময় যে মাছের প্রজনন ঋতু, সেইসময় সেই নির্দিষ্ট প্রজাতির মাছগুলো খাওয়া বন্ধ করুন।
‘ইন সিজন ফিশ’ এবং ‘আপনার মাছ জানুন’ এর মতো উদ্যোগগুলি- বিভিন্ন মাছের নির্দিষ্ট প্রজননের ঋতু এবং সেই সময়ের মধ্যে কোন কোন বিকল্প মাছ খাওয়া যেতে পারে, সে সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিয়ে সাহায্য করে।
সমুদ্র সংরক্ষণের দিকে কাজে সাহায্যকারী সংস্থাগুলিকে, আপনি সাহায্য করুন:-
যেমন সামুদ্রিক সংরক্ষণে কাজ করে এমন একটি স্থানীয় NGO গুলির স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যোগ দিন। এমন কয়েকটি সংগঠন হল- দক্ষিণ ফাউন্ডেশন, পঞ্চভূটা সংরক্ষণ ফাউন্ডেশন এবং রাশিকুলিয়া সাগর কচ্ছপ সুরক্ষা কমিটি ইত্যাদি।
নাগরিক-বিজ্ঞান উদ্যোগে সামিল হন:
প্রকৃতি ভ্রমণ এবং MLOM এর মত উদ্যোগগুলিতে যোগদান করুন। যারা কেবল সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতাই ছড়ায় না বরং বিভিন্ন সামুদ্রিক সম্প্রদায়ের তথ্য সংগ্রহ করে, নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সহায়তা করে।
ভ্রমনের সময় সমুদ্র সৈকতর যত্ন নিন:-
সমুদ্র সৈকত পরিদর্শন সময়, সমুদ্র সৈকতে কোন বর্জ্য ফেলে অপরিষ্কার করবেন না। স্থানীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন উদ্যোগে যোগদান করে, নিজেকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে পারেন।একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হোন। আপনার জন্য ও এ সকল জীবের জন্য, এই পৃথিবীকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করে তুলুন।