শুধুমাত্র ড্রপ প্রয়োগে ছানি নির্মূল করা সম্ভব হবে আর প্রয়োজন হবে না অপারেশনের, এমনটাই দাবি করলেন গবেষকদল
নিউক্র্যাড হেলথ বাংলার নিজস্ব প্রতিবেদন
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া (সান ফ্রান্সিসকো); মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেন্ট লুইসে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির গবেষকদের একত্রিত উদ্যোগে একটি চোখের ড্রপ উদ্ভাবন করেছেন, যা চোখের ছানি দ্রবীভূত করতে পারে। একটি মর্যাদাপূর্ণ জার্নাল, ‘নেচার’-এ তাদের গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, এবং সারা বিশ্বে গবেষকরা তাদের প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ করেছেন। এটি অপটিকাল সায়েন্সের জগতে বিপ্লব বয়ে আনবে বলে মনে করা হচ্ছে, কারন বিশ্বব্যাপী বয়স্কদের মধ্যে অন্ধত্বের প্রধান কারণ ছানি।
ছানি কি?
ছানি একটি এমন অবস্থা যেখানে ব্যক্তি চোখে লেন্সর উপর পাতলা একটি আস্তরণ পড়ে যায়। রোগীদের দৃষ্টিশক্তি আবছা ও ক্ষীণ হয়ে আসে। সংবাদপত্র পড়া, রাতে গাড়ি চালানো এবং অন্যদের মুখের এক্সপ্রেশন বোঝা, টিভি দেখা এসবই তাদের কাছে কঠিন হয়ে পড়ে।
চার ধরণের ছানি দেখা যায়-
- নিউক্লিয়ার ক্যাটার্যাক্ট,
- কর্টিকাল ক্যাটার্যাক্ট,
- পস্টেরিয়র সাবক্যাপসুলার ক্যাটার্যাক্ট,
- কনজেনিটাল ক্যাটার্যাক্ট।
যদিও খুব বেশি পাওয়ারের চশমার ব্যবহার শুরু শুরুতে ঠিকঠাক দেখতে সাহায্য করতে পারে, দীর্ঘদিন ধরে ছানি অন্ধত্ব পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
ছানির সাধারণ উপসর্গগুলি কি কি?
- ঝাপসা দেখা।
- রাতে বড় ছোট যেকোনো জিনিসই দেখতে খুবই অসুবিধা হওয়া এবং চলাফেরা করতে অসুবিধে হওয়া।
- নিউজ পেপার বা কোন কিছু দেখার জন্য বেশি আলোর প্রয়োজন।
- আলোর দিকে তাকালে তার চারপাশে কালো ছায়া ছায়া অংশ দেখা।
- মাথার অসহ্য যন্ত্রণা ও বমি বমি ভাব ।
- সমস্ত জিনিস ডবল করে দেখা।
ছানি থেকে অন্ধত্ব ব্যাপারটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আসুন সেই বিষয়ে তথ্য জেনে নেয়া যাক:-
ফ্রেড হলোস্ ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী 32.4 মিলিয়ন ব্যক্তি চোখে ছানির কারণে অন্ধ হয়ে গেছে। আমেরিকান একাডেমী অফ অপথ্যালমলজি সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে; যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 40 বছর বা তার বেশি বয়সী 22 মিলিয়ন মানুষ ছানির কারণে চোখের সমস্যায় ভোগেন। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে প্রভাব সবথেকে বেশী, প্রায় 90 শতাংশ মানুষ এই সমস্যায়, কিন্তু দারিদ্র্য ও অবকাঠামোর অভাব এই সমস্যাটির সঠিক চিকিৎসা করানোর পরে বাধা সৃষ্টি করে।
নিশ্চয়ই পরিসংখ্যান এর বহর দেখে বুঝতেই পারছেন কত মানুষ এই কারণে প্রতিনিয়ত সমস্যায় ভুগছেন। সেখানে অস্ত্রোপচার করার পরিবর্তে যদি শুধুমাত্র ড্রপ ব্যবহার করে এর থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তাহলে পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ আবার চোখের সমস্যা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন।
ছানির চিকিৎসায় ব্যবহৃত এই ড্রাপে কী এমন আছে?
এই নতুন চোখের ড্রপ ছানির আস্তরণ সঙ্কুচিত করে ও দ্রবীভূত করে । এটি একটি প্রাকৃতিক স্টেরয়েড দিয়ে গঠিত, যার নাম ল্যানোস্টেরল। কিছুদিন আগে চীনের দুই সন্তান কনজেনিটাল ক্যাটার্যাক্টে আক্রান্ত হয়, অথচ তাদের বাবা-মায়ের এই ধরণের কোনো সমস্যাইনেই। চিকিৎসকেরা এ ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয় আর পিছনে কি কারণ সেটা খুঁজতে গিয়ে দেখেন ওই দুটি শিশুর পিতা ও মাতা দুজনের দেহেই ল্যানোস্টরল নামক প্রোটিনটি স্বাভাবিক ভাবে তৈরি হয়, যা ছানি পড়তে বাধা সৃষ্টি করে। কিন্তু কোনো মিউটেশন জনিত কারণে তাদের সন্তানদের দেহে এই যৌগটি বিকাশের বিকাশহয়নি এবং এ কারণেই তারা জন্মগত চোখের সমস্যা থেকে ভুগছে। এই ক্ষেত্রে বিস্তারিতভাবে গবেষণার পর, বিজ্ঞানীরা উপসংহারে বলেছিলেন যে লানোস্টেরল ত্রুটিযুক্ত স্ফটিক প্রোটিনগুলিকে একসাথে আটকাতে এবং একটি ছানি গঠন করতে বাধা দেয়। এই স্টেরয়েড নন কনজেনিটাল ছানির চিকিৎসায় ব্যবহৃত করা যাবে।
চিকিৎসকেরা ল্যানোস্টেরল ড্রপ এর কার্যকারিতা কিভাবে পরীক্ষা করলেন সেই গল্প জেনে নেয়া যাক:-
গবেষকরা তিনটি ধাপে এই ড্রপটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করেন।
প্রথমে তারা মানুষের চোখের লেন্সে এই ড্রপটি প্রয়োগ করে এবং দেখা যায় যে ড্রপটি উল্লেখযোগ্যভাবে, মানুষের চোখের লেন্সের উপর যে আস্তরণ পড়ে ছিল তা কম করতে সাহায্য করেছে। মানুষের চোখের উপর পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা একদল খরগোশের এর ওপরে এই পরীক্ষাটি করেন, খরগোশের চোখে ড্রপটি ব্যবহার করার 6 দিনের দিনে উল্লেখযোগ্যভাবে তাদের চোখের উপরে ছিনির আস্তরণ কম হয়, কিছু-কিছু জনের ক্ষেত্রে তো একেবারেই কমে যায়। তারপর চিকিৎসক দল কুকুরের চোখের ওপর এটি প্রয়োগ করেন এবং এক্ষেত্রেও দেখা যায় যে এটি ছানি কমাতে সাহায্য করেছে। ক্লিনিকাল ট্রায়াল শেষ হয়ে গেছে এরপর কিভাবে এটিকে ড্রপ হিসাবে বাজারে নিয়ে আসা যায় তার উপরে কাজ চলছে। আশা করা যায় খুব তাড়াতাড়ি এই পৃথিবীর বুকে হাজার হাজার মানুষের চোখের অন্ধকারে কাটিয়ে আলো পৌঁছে দিতে সফল হবে এই ড্রপটি।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, আরো নতুন নতুন বিজ্ঞানের চমকপ্রদক খবর জানতে নিউক্র্যাড হেলথ বাংলার পেজ ফলো করুন।