এপ্রিল 28, 2024

সাবধান! কম সময়ে ‘ক্রাশ ডায়েট’ ওজন কমানোর চেষ্টা, ভেঙে দিতে পারে আপনার স্বাস্থ্য!!

Reading Time: 3 minutes

লিখেছেন মনিকা কুন্ডু শ্রীবাস্তব, অনুবাদে- মোনালিসা মহান্ত

সাম্প্রতিক, ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ- দ্রুত ওজন হ্রাসের জন্য জনপ্রিয় ‘ক্র্যাশ ডায়েট’গুলি কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি, বিপদজনক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরী করতে পারে, তার উপর সচেতনতা মূলক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

বিশ্বনাথন মোহন (মাদ্রাজ ডায়াবেটিস রিসার্চ ফাউন্ডেশন) এবং ডাঃ শীলা জোশী (মুম্বাই ডায়েট অ্যান্ড হেলথ সেন্টার) এই ধরনের ডায়েট প্ল্যান গুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন-

এমন ডায়েট যেখানে, খাদ‍্যতালিকায় কম কার্বোহাইড্রেট ( প্রতি দিন 100 গ্রামের কম কার্বোহাইড্রেট) এবং বেশি ফ‍্যাটযুক্ত (প্রতিদিন প্রায় 60%) খাবার রাখা হয়। যেমন অ্যাটকিনস এর ডায়েটচার্ট, প্রোটিন পাওয়ার লাইফপ্ল‍্যান ইত্যাদি।

কম ফ‍্যাটযুক্ত (11-19%) খাদ্য তালিকা যুক্ত ডায়েট চার্ট।
যেমন- ডীন অরনিনিশ ডায়েটে (মূলত একটি নিরামিষ ডায়েট)। এবং প্রিটিকিন ডায়েট (এক্ষেত্রে খাদ‍্যতালিকায় সীমিত পরিমাণ, নির্বাচিত কিছু কম-ফ‍্যাটযুক্ত প্রানীজ প্রোটিন থাকে ) ; এবং

খুব কম ফ‍্যাটযুক্ত (10% কম) খাদ্যতালিকা।

তাঁরা ডায়েট প্যাটার্ন গুলিকে ভাগ করে নেবার পর; এগুলো কীভাবে দ্রুত ওজন হ্রাস করে ও শরীরের উপর কী প্রভাব তৈরি করে, তা বিশ্লেষণ করেছেন ।

প্রাথমিক পর্যায়ে ‘লো-কার্বোহাইড্রেট / হাই ফ‍্যাট’ ডায়েটে দেহে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ হ্রাস পায়। এর ফলে দেহের থেকে প্রচুর জল বেরিয়ে যায়, এবং শরীরের ওজন কিছুটা হ্রাস পায়। তারপরে, ফ‍্যাটের পরিবর্তে কার্বোহাইড্রেট কম গ্রহণের কারণে ওজন কম হতে থাকে।
তবে যে পরিমাণ ফ‍্যাট জাতীয় খাবার খেতে বলা হয়, তার খাওয়া সম্ভব হয় না।এর একটা কারণ হতে পারে, কেউ সচেতনভাবে খুব বেশী দুগ্ধজাত ফ্যাট খেতে পারে না এবং অধিকাংশ ভারতীয়ই ডিম বা মাংসের চেয়ে প্রতিদিনই বেশি নিরামিষ খাবারই বেশি গ্রহণ করে।
এই খাদ্য তালিকায় প্রোটিনের পরিমাণ ও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়। কার্বোহাইড্রেট এবং ফ্যাট কম গ্রহণের ফলে তৈরী হওয়া ‘শক্তি ঘাটতিই’ ওজন কমার আসল কারণ।

কম সময়ের মধ্যে গ্রহণ করা কম কার্বোহাইড্রেট / উচ্চ-চর্বিযুক্ত খাবার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। ‘লো কার্বোহাইড্রেট ডায়েটে’- ফল, শাকসবজি এবং হাইফাইবার যুক্ত খাবার কম পরিমাণে থাকে, যা অন্ত্রে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। খুব বেশি প্রোটিন গ্রহণ হাড়কে দুর্বল করে তোলে। এক্ষেত্রে ক্যালসিয়াম হাড় গঠনের বদলে, প্রস্রাবের মাধ্যমে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়।

“লো-ফ‍্যাট ডায়েট”এ খাদ‍্যতালিকায় উচ্চ-কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার এবং সবজি, ফল, গোটা শস্য এবং মটরশুটি, ডিমের সাদা অংশটি ,ফ‍্যাটহীন দুধ, সোয়াবিন,সাদা-আটার মতো খাবার থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই ডায়েট, শরীরের ক্ষতিকর কলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস করে। কিন্তু, খাদ্যতালিকায়, 70 শতাংশেরও বেশি কার্বোহাইড্রেট থাকায় দেহে সংরক্ষিত ফ‍্যাটের (ট্রাইগ্লিসারাইডের) মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। তবে, যদি পর্যাপ্ত ফাইবার যুক্ত খাবার যোগ করা যায় তাহলে, কোলেস্টেরল এবং রক্তচাপ হ্রাস পায়।অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ঔষধগুলি ব‍্যবহারের প্রয়োজনীয়তাও হ্রাস পায়। এই খাদ্যগুলি সাধারণত রক্তের গ্লুকোজ এবং ইনসুলিনের মাত্রা হ্রাস করে যা ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ।

অনুকূল বিপাকীয় পদ্ধতিতে ওজন কমানোর করার জন্য বিশেষজ্ঞরা স্বল্পমেয়াদী ‘খুব কম কার্বোহাইড্রেট যুক্ত ডায়েট’ (দৈনিক 800 কিলোক‍্যালোরি বা প্রতিদিন 80 গ্রাম কার্বোহাইড্রেট ও 15 গ্রাম চর্বিযুক্ত খাবার) সুপারিশ করেন। সাথে দুধ, সোয়া বা ডিমের প্রোটিন যুক্ত পাউডার জলের সাথে মিশিয়ে খাবার পরামর্শ দেন, যাতে দেহে প্রোটিনের চাহিদাও পূর্ণ হয়, আবার শরীরের শুষ্ক ওজনও সংরক্ষিত হয়। এর সাথে সাথেই, ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের দৈনিক প্রয়োজনীয়তা (RDA-Recommended daily allowance) নিশ্চিত করতে হবে। প্রোটিন উৎস হিসেবে মাছ এবং হাঁস-মুরগির ডিম ও মাংস খাওয়া যেতে পারে। এবং এরই সাথে এই খাদ্য তালিকায় মাল্টিভিটামিন , প্রতিদিন 2-3 গ্রাম পটাসিয়াম এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ জলপান নিশ্চিত করাটাও আবশ্যক।

তবে খুব কম কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার পিত্তথলিতে পাথর, পেশীর দুর্বলতা, দেহের ক্লান্তি বাড়িয়ে দেয়। আবার দেহে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি করে যন্ত্রনাদায়ক অস্থিসন্ধির মতো বিভিন্ন সমস্যা তৈরী করে।
এছাড়াও এই গবেষণায়, কম কার্বোহাইড্রেট যুক্ত ডায়েটিং প্ল‍্যানগুলির দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা তথ্য এবং এই খাদ‍্যাভাস শরীরে কোনও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের অভাবের কারণ হতে পারে কিনা সে সম্পর্কেও বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

দ‍্য প্রসপেক্টিভ আর্বান এন্ড রুরাল এপিডেমিওলজিক‍্যাল (PURE) এর গবেষণাযতেও দেখা গেছে যে উচ্চ-কার্বোহাইড্রেট যুক্ত ডায়েটের ফলে মৃত্যুহার অনেক বেশি, সম্ভবত রক্তের সুগারের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় কারণে স্থূলতা বৃদ্ধি পায় এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বাড়ে। আবার অন‍্যদিকে খুব কম কার্বোহাইড্রেট যুক্ত ডায়েট রক্তের সুগারের পরিমাণ ভীষণ ভাবে কমিয়ে শরীরকে দুর্বল করে দেয়। সঠিক চিকিৎসার অভাবে এই সমস্যা গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন 500-1000 কিলোক‍্যালোরি ক্ষয় করেই ওজন কমানো সম্ভব। তবে নিয়মিতভাবে এমন খাদ্যভাস চালিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য, তাই এক্ষেত্রে মাঝপথে ছেড়ে দেবার হারও অনেক বেশি।
এটি প্রস্তাবিত যে একটি সুষম ও সুস্বাদু খাদ্য যা ওজন হ্রাসের কারণ হতে পারে, তাতে কম ক‍্যলোরি, মাঝারি কার্বোহাইড্রেট (40 – 50%) এবং ফ‍্যাট (30%) যুক্ত খাবারের পাশাপাশি, পর্যাপ্ত মোনোআনস‍্যাচুরেটেড ফ্যাট ও প্রোটিন (20-25%) ও প্রচুর সবুজ শাক সবজি রাখা উচিৎ।
গবেষণায় প্রত‍্যেকের জন্য পৃথক পৃথক কর্মসূচীর প্রস্তাব করা হয়। বিভিন্ন ধরণের খাবারের বিকল্প (সম্পূরক সহ) খাবার সাথেই , ওজন কমানোর জন্য ব‍্যায়াম করা এবং নিয়মিত কাউন্সেলিং করানোর পরামর্শও দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ‘ক্র্যাশ ডায়েট’ করে হঠাৎ ওজন কমানোর পরিবর্তে, এভাবে ওজন কমানোর পদ্ধতি; ভারতীয়দের মধ্যে ব‍্যপকভাবে স্থূল হওয়ার যে প্রবণতা দেখা যায় তা নিয়ন্ত্রণ করার সহায়ক হবে।

অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেসের সিনিয়র ডায়েটিসিয়ান মিস্ অনুজা আগারওয়াল, যিনি পর্যালোচনাটির সাথে যুক্ত ছিলেন না, বলেন, “গবেষণাটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এটি ডায়েট চার্ট তৈরীর সময় পেশাদারদের মধ্যে ঐক্যের অভাবের কারণে, সাধারণ মানুষকে যে বিভ্রান্তিকর অবস্থায় ভোগ করতে হয়, তার অবসান করতে পারে”।
এই গবেষণার তৈরী খাদ‍্যতালিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “ভারতীয়দের উপর দীর্ঘ সমীক্ষা চালিয়ে তৈরী করা এরকম একটি আদর্শ খাদ্য তালিকার অত‍্যন্ত প্রয়োজন ছিল।”