ভারতে লিঙ্গ-অনুপাতের পরিবর্তন – লিঙ্গ নির্ধারিত গর্ভপাতের পরিণাম
অঙ্কিতা তা । নিউক্র্যাড হেলথ বাংলার নিজস্ব প্রতিবেদন
আপনি কি জানেন যে ভারতের কিছু উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যের অনেক অবিবাহিত পুরুষ তাদের বিবাহযোগ্য পাত্রী খুঁজে পাননা? হরিয়ানা জেলার অনেক পুরুষকে শত শত কিলোমিটার গমন করতে হয় কারণ তাদের এলাকায় বিবাহযোগ্য নারীদের মারাত্মক অভাব রয়েছে। এই নয় যে এসব এলাকায় মেয়েরা রাতারাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন। কয়েক দশক ধরে অবৈধভাবে গর্ভাবস্থায় লিঙ্গ-নির্ধারণ ও কন্যা ভ্রূণহত্যা লিঙ্গ-অনুপাত পরিবর্তনের একটি বড় কারণ। পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, হিমাচলপ্রদেশ ও গুজরাটের মতো অনেক রাজ্যে, ভ্রূণহত্যার ফলে লিঙ্গ-অনুপাত হ্রাস পেয়েছে। একাধিক প্রমাণ রয়েছে যে পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যে, যদি এইভাবে লিঙ্গ নির্ধারণ করে কন্যা ভ্রূণহত্যার মতো অনৈতিক অনুশীলন বন্ধ না করা হয় তবে ভারতকে জনসংখ্যার প্রকৃতির পরিবর্তনের সম্মুখীন হতে হবে।
ভারতে বর্তমান লিঙ্গ-অনুপাত কি?
ইউনাইটেড নেশনস এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৯ সালে ভারতবর্ষে লিঙ্গ প্রতি অনুপাত ১০৭.৪৮ পুরুষ প্রতি ১০০ জন মহিলা। এটি ইঙ্গিত দেয় যে ভারতবর্ষে প্রতি ১০০০ জন নবজাতক প্রতি শুধুমাত্র ৯৩০ জন নবজাতিকা রয়েছে। ২৯ টি রাজ্যের মধ্যে কেরালাতে সর্বোচ্চ লিঙ্গ-অনুপাত ১০৮৪ জন মহিলা প্রতি ১০০০ জন পুরুষ আবার হরিয়ানায় ১০০০ জন পুরুষ প্রতি ৮৭৯ জন মহিলা। এই পরিসংখ্যান তুলনা করলে দেখা যায় যে আমাদের দেশে ৫১.৮০ শতাংশ পুরুষ ও ৪৮.২০ শতাংশ মহিলা রয়েছেন। বর্তমানে পরিবর্তিত লিঙ্গ-অনুপাতের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১টি দেশের মধ্যে ভারতবর্ষ ১৯১তম অবস্থানে রয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলিতেও অবস্থা খুব উজ্জ্বল নয়। নেপাল, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও চীনেও একই পরিসংখ্যান দেখা যায়।
ভারতে অস্বাভাবিক লিঙ্গ অনুপাতের কারণ কী?
বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কারণে ভারতে অস্বাভাবিক লিঙ্গ-অনুপাত ও কন্যা ভ্রূণহত্যা হয়, তার মধ্যে কয়েকটি কারণ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা যাক।
সাংস্কৃতিক পক্ষপাত
অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায় যে, বাবা-মা একটি পুরুষ সন্তানকে পছন্দ করেন কারণ তারা বিশ্বাস করেন যে কেবলমাত্র একটি ছেলেই বংশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। পুরুষ-শাসিত সমাজ ব্যবস্থাই ভারতে এই সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণ। অনেক বাবা-মা মনে করেন, একটি ছেলে একটি মেয়ের তুলনায় শারীরিকভাবে বেশি শক্তিশালী ও সে বড় হলে তাদের কায়িক শ্রম ভাগ করে নিতে পারবে। এই সংস্কৃতিটি বেশিরভাগ কৃষকশ্রেণীর মধ্যে দেখা যায় যারা কৃষি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে তাদের দৈনন্দিন অর্থ উপার্জন করেন। এই সামাজিক বিশ্বাস ও রীতিগুলি ভাবী বাবা-মায়ের মধ্যে অবৈধভাবে লিঙ্গনির্ধারণের ইচ্ছা বাড়িয়ে তোলে। ফলস্বরূপ গর্ভে কন্যাসন্তান আছে জানতে পারলে তারা সংস্কৃতিক অগ্রাধিকারের জন্য গর্ভপাত করিয়ে থাকেন।
ভারতে পণপ্রথা
কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে, পণগ্রহণের প্রাচীন প্রথা রয়েছে, যেখানে বিবাহের পূর্বে উপহার হিসাবে বরের পরিবারকে নববধূর বাবা-মায়ের যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করা আবশ্যক। যদিও, এই ঐতিহ্য ঐতিহাসিক সাহিত্যে (গ্রন্থ গুলিতে) উপহার হিসেবে উল্লেখিত আছে। প্রকৃতপক্ষে, অনেক পরিবার পাত্রীর বাবাকে অর্থ প্রদানের জন্য সম্মত করান কারণ সমাজ নারীকে পুরুষের থেকে কম কার্যক্ষম বলে মনে করে। কিছু সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে, একটি ছেলেকে বড় করে তোলাই অর্থের দিক থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত কারণ তারা বিবাহের সময় যৌতুক হিসাবে প্রচুর টাকা নিয়ে আসবে। এইসব অযৌক্তিক পরম্পরা ভারতের অনেক রাজ্যে প্রচলিত আছে যা লিঙ্গ নির্ধারিত গর্ভপাতের কারণ।
দূর্বল সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা
অনেক ক্ষেত্রে, মানুষ তাদের ভবিষ্যতের জন্য কার্যকরভাবে পরিকল্পনা করে না, ফলে বয়সকালে তাদের সঞ্চয় বেশি থাকে না ফলস্বরূপ অবসর-পরবর্তীকালে তারা সন্তানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরেন। ভারতীয়দের বিশ্বাসানুসারে, যেহেতু মেয়েরা বিয়ের পরে একটি ভিন্ন পরিবারে যায়, তাদের পক্ষে তাদের বাবা-মায়ের যত্ন নেওয়া অসুবিধাজনক। তারা মনে করেন যে একটি পুত্রসন্তানই বৃদ্ধাবস্থায় বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে সক্ষম।
কন্যা ভ্রূণহত্যা প্রতিরোধে সরকার কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে?
১৯৯৪ সালে ভারত সরকার প্রিকনসেপশন ও প্রিন্যাটাল ডায়াগনস্টিক টেকনিকস অ্যাক্ট (PCPNDT) পাস করে যা ভ্রূণের লিঙ্গ-নির্ধারণকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করে। এই আইন ২০০৩ সালে সংশোধিত হয়েছিল, যাতে কোনো পেশাদারী চিকিৎসক আলট্রাসোনোগ্রাফির সাহায্যে কোনো শিশুর লিঙ্গ-নির্ধারণ করতে না পারেন। তাও, অনেক গ্রামীণ এলাকায়, মানুষ এই নিয়ম ও আইন লংঘন করেন। অনেক জায়গায় গোপনে এই লিঙ্গ নির্ধারণ এখনও চালু রয়েছে।
অবশেষে, আমরা বলতে পারি যে, হরিয়ানার পাত্ররা উপযুক্ত পাত্রীর খোঁজে কেরালা যেতেই পারে, তবে বর্তমান পরিস্থিতির ফলে একটি দীর্ঘমেয়াদী জনসংকট দেখা দিতে পারে। পরিণতি স্বরূপ নারী-পাচার, বাল্যবিবাহ ও যৌন আক্রমণের মতো পরিস্থিতিগুলি দেখা দিতে পারে। তাই, পরিস্থিতি যতক্ষণ আমাদের হাতে আছে, আমাদেরই পরিস্থিতি সামলানো উচিত।