টারগেটেড আলট্রাসাউন্ড অর্জুনের লক্ষ্যভেদের মতই ধ্বংস করছে ক্যানসার কোষ – গবেষণা
নিউক্র্যাড হেলথ বাংলা র নিজস্ব প্রতিবেদন
ইদানীং কালে আমরা প্রায়ই শুনি ফোকাসড্ আলট্রাসাউন্ড পদ্ধতি দ্বারা শরীরের কিছু কিছু অঙ্গের টিউমারের চিকিৎসা করা হয়। ডাক্তারবাবুরা উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন UV beams বা Ultra violet রশ্মি দিয়ে প্রথমে ওই টিউমারের কোষগুলিকে উত্তপ্ত করে অবশেষে ধ্বংস করেন। কখনও আবার এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে কনট্রাস্ট ডাই (Contrast dye) ব্যবহার করেন। দেখা গেছে এই দুইধরনের পদ্ধতিতেই চিকিৎসা করতে গেলে আক্রান্ত কোষগুলি ছাড়াও তার পাশে পাশে থাকা শরীরের সুস্থ কোষগুলির উপরও ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে ফলে রোগী আরও বেশী অসুস্থবোধ করতে থাকে। কিন্তু এখন আপনার দুঃচিন্তা দূর করতে স্বনামধন্য ক্যালিফর্নিয়া ইনষ্টিটিউট অফ টেকনোলজি (California, Institute of Technology) ও সিটি অফ হোপ বেকম্যান রিসার্চ ইনষ্টিটিউট (City of Hope Beckman research Institute) এর গবেষকদের দল একটি যুগান্তকারী পদ্ধতির সাহায্যে ক্যানসারের কোষগুলি ধ্বংস করার উপায় বের করেছেন। এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে কেবলমাত্র ক্যানসারের কোষ গুলিকে ধ্বংস করা যাবে আশেপাশের সুস্থকোষ গুলির কোনোরকম ক্ষতি না করেই।
ক্যালিফর্নিয়ার গবেষকদের দলটি ঠিক কি উপায় উদ্ভাবন করলো?
বিজ্ঞানীরা ম্যালিগন্যান্ট কোষ গুলিকে মেরে ফেলার জন্য সাধারণত low-intensity ultrasound রশ্মির ব্যবহার করতে চলেছেন যা কেবলমাত্র দুষ্ট কোষ গুলোকে নষ্ট করে, অন্য কোনো কোষের ক্ষতি না করে ফলে এখন ক্যানসারের রোগীরা যারা থেরাপির সাহায্য নিচ্ছেন তারা অনেক কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সন্মূখীন হন এবং শারীরিক দিক থেকে অনেকটা কম ধকলের মধ্যে দিয়ে যান।
এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগগ্রস্থ কোষের গঠনগত (Structural) ও প্রকৃতিগত (Physical) গুণাবলী বিশ্লেষণ করে সঠিক পূর্বাভাষ দেওয়া যায় যে ঠিক কোন কোষের উপর টার্গেট করা হবে, এবং তারা বিশ্লেষণের ফলাফল অনুযায়ী আলট্রাসাউন্ড এর intensity বা প্রাবল্য অর্থাৎ শক্তির সাথে টার্গেট কোষগুলির সংগঠনের হারের সাথে সদৃশ্য অনুযায়ী থেরাপি নির্দিষ্ট করেন ফলে সুস্থকোষগুলির ক্ষতি হয় না। আগে যে ধরনের রেডিওথেরাপির পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তার থেকে টার্গেটেড আলট্রাসাউন্ড অনেকটাই আলাদা কারণ এই ক্ষেত্রে আঘাত করা হবে যে কোষগুলিকে যেগুলিকে নির্দিষ্ট করার জন্য কোনো মলিকিউলার মার্কারের ব্যবহার করার দরকার হয় না। বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে এই পদ্ধতি পরীক্ষাগতভাবে ব্যবহার করে দেখেছেন এর দ্বারা রোগগ্রস্থ কোষগুলিকে ধ্বংস করা যায়, সুস্থ ব্লাড সেল গুলোকে কোনো ক্ষতি না করেই।
গবেষণার ফলাফল কি পাওয়া গেন?
এই নতুন টেকনোলজি বা প্রযুক্তিটিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন অঙ্কোট্রিপসি (Oncotripsy) এবং এই প্রযুক্তির যাবতীয় ফলাফল, বিশ্নেষণকে তারা ব্যবহারিক পদার্থ বিদ্যার একটি পত্রিকা (Journal Applied Physics Letters) এর জানুয়ারী ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশ করেছেন। জার্নালটির প্রধান লেখক Devid Mittelestein, যিনি পাসাডেনা ক্যালিফর্নিয়া ইনষ্টিটিউটের গবেষক অসাধারণ উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সাফল্যের বিষয়ে গভীর সন্তুষ্টি জানিয়েছেন।
যদিও এটাও মাথায় রাখা দরকার যে বর্তমানে এই পদ্ধতিটি সবেমাত্র প্রাথমিক স্তরে রয়েছে এবং যতবেশী বিষয়টির উপর কাজ হবে তত সুক্ষভাবে, সঠিকভাবে রশ্মিকে নির্দিষ্ট কোষে নিক্ষেপ করা যাবে। Mittelestein এবং সহকর্মীরা অবশ্য আশাবাদী যে আরও বেশী বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এগিয়ে আসবে বিষয়টির উপর আরো নিবিড় গবেষণা করতে। ভবিষ্যতে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ বা অঙ্কোলজিষ্টরা কেমোথেরাপি, ইমিউনো থেরাপি, রেডিয়েশন ও সার্জারির মতো প্রতিষেধক মূলক চিকিৎসার পাশাপাশি টারগেটেড আলট্রাসাউন্ড পদ্ধতিটিও ক্যানসার রোগের সাথে লড়াইয়ের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবেন।
আলট্রাসোনোগ্রাফি কি বা কাকে বলে?
আলট্রাসোনোগ্রাফি হলো একটি ডায়গনষ্টিক পদ্ধতি যেখানে রেডিওলজিষ্ট আলট্রাসোনিক কম্পন (মানুষের শ্রবনগ্রাহ্য কম্পাঙ্কের বেশী কম্পাঙ্কের শব্দ তরঙ্গ)পাঠানো হয় নরম কলাকোষ গুলির যেমন টেনডনসমূহ পেশীসমূহ, রক্তজালকগুলি ও আভ্যন্তরীন সমস্ত অঙ্গের একটি প্রতিচ্ছবি পাওয়ার জন্য। এই ধরনের ডায়গনষ্টিক পদ্ধতিতে সাধারণত 20000 Hz এর সাউন্ড ফ্রিকোয়েন্সি বা শব্দতরঙ্গের কম্পাঙ্ক ব্যবহার করা হয়, বর্তমানে এই পদ্ধতিটির সাহায্য ডাক্তাররা মানব শরীরের আভ্যন্তরীন অঙ্গসমূহের কোনোরকম ব্যতিক্রম কে সহজে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
টারগেটেড আলট্রাসোনোগ্রাফি বলতে কি বোঝায়?
যখন রেডিওলজিষ্ট কেবলমাত্র নির্দিষ্ট করে প্রয়োজনীয় কলাকোষ বা অঙ্গটুকুর উপরই রেডিয়েশন বা বিকিরণটি নিক্ষেপ করেন তখন তাকে টারগেটেড আলট্রাসোনোগ্রাফি বা সুনির্দিষ্ট বা লক্ষ্যিত আলট্রাসোনোগ্রাফি বলে। এখনও অবধি চিকিৎসকেরা কেবল মাত্র ডায়গনিস্টিক পরীক্ষা সমূহের ক্ষেত্রেই টারগেটেড আলট্রাসোনোগ্রাফি ব্যবহার করেছেন কিন্তু ভবিষ্যতে সুনির্দিষ্ট বিকিরন প্রক্ষেপনের বিষয়টি যত উন্নত হবে টারগেটেড আলট্রাসোনোগ্রাফি অনেক বেশী হারে জটিল রোগসমূহ যেমন ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহার করবেন ডাক্তাররা।
আলট্রাসোনোগ্রাফির অন্যান্য উপযোগীতা সমূহ-
গর্ভাবস্থায় আলট্রাসোনোগ্রাফি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিয়ে থাকে। এটি ব্যবহার করে প্রসবের আসন্ন সময়, একটোপিক প্রেগনেন্সি অর্থাৎ জরায়ু ছাড়া অন্যকোথাও যদি ভ্রণের বৃদ্ধি হতে থাকে, ভ্রনের আভ্যন্তরীন কোনো অঙ্গ গঠনে কোনোরকম সমস্যা দেখা দিয়েছে কিনা, মায়ের গর্ভে বাচ্ছার অবস্থান (Position), কোনোরকম Congenital disabilities অর্থাৎ জন্মগত ক্রটি আছে কিনা এই সমস্তই জানা যায়। বেশীরভাগ গর্ভবতী মা, আসন্ন প্রসবা মাকে নিয়মিত ব্যবধানে আলট্রাসোনোগ্রাফি করতে হয় গর্ভকালীন অবস্থায়, গর্ভস্থ ভ্রুণের ভালোমন্দ বোঝার জন্য। এই স্বল্প পরিসরে ক্যানসারের মতো মারণরোগের চিকিৎসায় টারগেটেড আলট্রাসোনোগ্রাফির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হল। আপাততঃ বিষয়টি বিজ্ঞানের নবতম একটি পদক্ষেপ হলেও অদূর ভবিষ্যতে এই পদ্ধতিটি আরো উন্নত হয়ে অনেক বেশী নিরাময়ের মাধ্যম হয়ে উঠবে বলে আশা রাখা যেতেই পারে।