ভারতের আট সন্তানের মধ্যে অন্তত একজনের নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসর্ডার রয়েছে – এমনি বলছে গবেষণা
অক্ষরদান মোনালিসা মহান্ত ফেব্রুয়ারি 24, 2019
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব ! মানুষের উন্নত মস্তিষ্ক, তার বৌদ্ধিক ও জ্ঞান মূলক দক্ষতা তাকে এনে দিয়েছে এই শিরোপা। মানুষ এই সমস্ত দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে স্মৃতিশক্তি, পড়ালেখা, খেলাধুলা, গান-বাজনা, গাড়ি চালানো ইত্যাদির ক্ষমতাকে আয়ত্ত করেছে। শিশু অবস্থা থেকেই মস্তিষ্কের গঠনগত বিকাশের পথ শুরু হয়ে যায়। শিশুর বিকাশের সাথে সাথেই তার শিখন দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরতে শুরু করে,যা পরোক্ষভাবে মস্তিষ্কের গঠন গত বিকাশের পথ সুগম করে তোলে ও বিভিন্ন দক্ষতা গুলিকে অর্জনে সাহায্য করে।
কিন্তু, মস্তিষ্কের এই গঠনগত প্রগতিশীলতার পথ একটুও বিঘ্নিত হলে দেখা দেয় একগুচ্ছ সমস্যা। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় “নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার”। শুধুমাত্র বংশগতিই নয়, এই রোগের বিকাশে পরিবেশের ভূমিকাও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মূলত বিশ্বব্যাপি কম আয়যুক্ত গোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলির ক্ষেত্রে এই রোগের প্রকোপ একটু বেশি মাত্রাতেই দেখা যায়।
ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনবহুল দেশ গুলির মধ্যে একটি হওয়া সত্বেও; সাম্প্রতিককালের আগে ভারতের কাছে “নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডার” এর আক্রান্তদের সম্পর্কে কোনো হিসাব বা নথি ছিল না।
বর্তমানে এর উপর দেশব্যাপী এক যৌথ গবেষণা চালানো হয়েছিল। নিউ দিল্লির INCLEN ইন্টারন্যাশনাল ট্রাস্ট এর নেতৃত্বে, ৫৩ টি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা মিলে PLOS মেডিসিন পত্রিকায় একটি রিপোর্ট পেশ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে – ২ থেকে ৯ বছর বয়সী প্রতি জন ৮ শিশুর মধ্যে ১ শিশু নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার আক্রান্ত। এর চেয়েও খারাপ যে তথ্যটি উঠে এসেছে তা হল – আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র 1% এর চেয়েও কমজন চিকিৎসাধীন।
বিজ্ঞানীরা মূলত ভারতের পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের যথা- মধ্য উত্তর (পালওয়াল, হরিয়ানা), উত্তর (কাংগ্রা, হিমাচল প্রদেশ), পূর্ব (ঝিনাইদহ, ওড়িশা), পশ্চিম (উত্তর গোয়া) এবং দক্ষিণ ভারতের (হায়দ্রাবাদ, তেলঙ্গানা) থেকে; ২-৯ বছর বয়সী ৩৯৬৪ টি শিশু সংগ্রহ করে, তাদের পর গবেষণা চালান। তাদের মূলত দুটি দলে ভাগ করে নিয়ে নিরীক্ষণ চালানো হয়। ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের উপর দৃষ্টি দুর্বলতা, মৃগী, স্নায়ুতন্ত্রের বিকলতা ঘটিত সমস্যা – যেমন সেরিব্রাল পালসি, শ্রবণ-কথন বা ভাষাগত ত্রুটি, আত্মসংবৃতি, বাধাপ্রাপ্ত বৌদ্ধিক বিকাশ, এই সমস্ত বিষয়ের ওপর নিরীক্ষণ চালানো হয়। একইসাথে মনোযোগের ঘাটতি বা ‘হাইপার অ্যক্টিভ ডিজঅর্ডার’, শেখার অক্ষমতা – এই সমস্ত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ৬-৯ বছর বয়সী শিশুদের ওপর গবেষণা চালানো হয়।
পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে নমুনা সংগ্রহের কারণও বিশেষজ্ঞরা ব্যাখ্যা করেছেন। INCLEN – এর তরফ থেকে ডাঃ মহাপাত্র বলেছেন – ভারতের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ভারতের জনসংখ্যার উপর প্রভাব বিস্তারকারী। দেখা গেছে বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য যেহেতু আলাদা, তাই একটি অঞ্চলের মানুষের বৈশিষ্ট্যও কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের থেকে আলাদা। যার ফলে “নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজ্অর্ডার” গুলির বিকাশ বা রিস্ক ফ্যাক্টরও ভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন। তাই তাঁরা মূলত সমগ্র ভারতের একটি প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলার জন্যই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাদের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। তবে সাথে সাথেই তিনি এও জানিয়েছেন যে – যেহেতু তাদের এই গবেষণায় ভারতের সমগ্র অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না, তাই এই গবেষণা “নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজ্অর্ডার ” – এর প্রকৃত স্বরূপ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন ও হতে পারে। তবে তারা ভবিষ্যতে চেষ্টা করবেন ভারতের আরো অন্যান্য অঞ্চল থেকেও যাতে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তাহলে যে তথ্য উঠে আসবে সে ক্ষেত্রে ভারতে “নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজ্অর্ডার ” এর বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য অনেকটা সফলতা পাবে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে 6-9 বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে নিউরোডভ্যভমেন্টাল ডিসঅর্ডারগুলি বেশি ঘন ঘন হতে পারে। বিশেষতঃ যেসব শিশুদের প্রসব বাড়িতে করানো হয়েছে , জন্মের সময় কম ওজন, জন্মের সময় কাঁদতে বিলম্ব, গর্ভধারণের 37 সপ্তাহের আগে অকালে জন্ম, মস্তিষ্কের সংক্রমণ, অসুস্থ নবজাতকদের এই রোগগুলির বিকাশের ঝুঁকি বেশি বলে মনে করা হয়।
“নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডারে” আক্রান্ত শিশুর সঠিক চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে তা চিকিৎসা শাস্ত্রে ও আর্থসামাজিক দিকের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তাই প্রাথমিকভাবে গবেষকদের উপর ই এই রোগগুলির দ্রুত সনাক্তকরণ এবং তাদের সংশোধন করার দায়িত্ব বর্তায়।
“নিউরোডভ্যভমেন্টাল ডিসঅর্ডারগুলি” বেশিরভাগ শৈশবেই প্রভাব বিস্তার করে। INCLEN এর আরেক গবেষক লেখিকা মিস দেশমুখ বলেন – “এইভাবে রোগ নির্ণয়ের সুযোগ অত্যন্ত সংকীর্ণ।” যদি শৈশব কালেই কোনো শিশুর সঠিক চিকিৎসা না করা হয়ে থাকে, তাহলে পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন ধরনের ক্রনিক রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা থেকে যায়। তিনি আরো জানান – “এরা অন্যদের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। কলঙ্ক বৈষম্য, বঞ্চনা, অপরাধ মূলক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। এদের আয়ু ও কম হয়।”
শিশুর সাথে সাথে শিশুর পরিবারকেও বিভিন্ন আর্থসামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেহেতু এই চিকিৎসা ব্যয়বহুল অনেক ক্ষেত্রেই যা শিশুর পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও নিউরোডেভমেন্টাল ব্যাধিগুলির প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে সচেতনহয়ে “রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কর্মসূচী” (RBSK) চালু করেছে। গবেষণার ফলাফল- এই প্রোগ্রামটি যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে।
প্রফেসর আরোরা জানিয়েছেন – “গবেষণার ফল প্রকাশ করার পর, ভারত সরকার RBSK প্রকল্পটি শুরু করেছেন। বর্তমানে এই প্রকল্পের অধীনে গবেষণায় উল্লিখিত বিভিন্ন শিশু ব্যাধিগুলি সহ মোট 30 টি শিশু ব্যাধি নির্ণয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর পর এখান থেকে, আক্রান্তদের চিকিৎসা ও পরিচালনার জন্য ‘জেলা প্রারম্ভিক হস্তক্ষেপ কেন্দ্র’ (DEIC) পাঠানো হয়ে থাকে।”
এই গবেষণা “নিউরোডভাইভমেন্টাল ডিসঅর্ডারগুলির” জনসংখ্যা ভিত্তিক অনুমান প্রদানের পাশাপাশি, সরকার অধীনস্থ ‘সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা’ কেও (ইউএইচসি) প্রাসঙ্গিক তথ্য সরবরাহ করে।
যদিও এটি বাস্তব পরিস্থিতিগুলির একটি প্রতিচ্ছবি মাত্র , তবুও এটি এই রোগগুলির সাথে যুক্ত ঝুঁকিগুলির কারণগুলিকে তুলে ধরেছে। আশা করা যায় এই গবেষণায় উঠে আসা তথ্যগুলি আমাদের স্বাস্থ্য সমাজকে আরো ভালো সাশ্রয়ী সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে।