ডিসেম্বর 24, 2024

আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অরগ্যানিক ফার্মিং বা জৈব কৃষির প্রয়োজন আছে

pexels-photo-789555
Reading Time: 4 minutes

নিউক্র্যাড হেলথ বাংলার নিজস্ব প্রতিবেদন

বর্তমানে সুপারমার্কেট ও অনলাইন সব্জি বিক্রির সাইটের দৌলতে জৈব বা অরগ্যানিক শব্দবন্ধটি আমাদের সকলের পরিচিত। এই সমস্ত জৈব বা অরগ্যানিক বস্তু সমূহের সাথে আমাদের নিত্য চেনা কৃষিজাত জিনিসপত্রের দামের ফারাক লক্ষ্য করে আমরা অবাক হয়ে কৌতুহলবশতঃ অরগ্যানিক শব্দটিকে নিয়ে খোঁজখবর চালাই, এবং রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদির অপকারিতা ও আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অরগ্যানিক ফার্মিং বা জৈব কৃষির গুনাবলী নিয়ে ওয়াকিবহাল হতে থাকি ধীরে ধীরে।

জৈব সব্জি বা তরিতরকারি আসলে কি?

খুব সরল করে বলতে গেলে বলা যায় জৈব কৃষি হলো সেই চাষবাস পদ্ধতি যেখানে চাষী তার উৎপাদন করা ফসল গুলিতে কোনোরকম রাসায়নিক সার, রাসায়নিক কীটনাশক, অ্যান্টিবায়োটিক বা বৃদ্ধির অনুকূল কোনো হরমোনের প্রয়োগ করেননি, অর্থাৎ পুরো ফসল উৎপাদনের প্রক্রিয়াটিই প্রাকৃতিক ও নিরাপদ উপায়ে সম্পন্ন হয়েছে। যদি আমরা সভ্যতার প্রথমদিকের সময়ে ফিরে যাই তবে আমরা দেখবো, সেইসময়ে সমস্ত কৃষিই জৈব কৃষি যখন মানুষ প্রকৃতিকে বিশ্বাস করতো, প্রাকৃতিক বিষয়সমূহের উপর ভরষা রাখতো। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সারাপৃথিবীর খাদ্যভান্ডারে টান পরার ফলে প্রয়োজন হলো কম সময়ে, কম জায়গায় বেশী বেশী উৎপাদন। শুরু হলো রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছচারে ব্যবহার, নষ্ট হতে লাগল প্রকৃতির নিজস্ব ফলন এর রসায়ণ, উন্নত পৃথিবীর খিদে মেটাতে। প্রাথমিকভাবে চাষীরা উল্লসিত বোধ করলেও রাসায়নিক জিনিসের দীর্ঘ ব্যবহারে মাটির স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হতে লাগল, এবং ধীরে ধীরে মাটি তার প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদানগুলি হারাতে থাকলো যার প্রভাব পরলো মানুষের স্বাস্থেও। এমনকি

মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মানুষের জিনগত পরিবর্তন ও লক্ষ্য করা গেলো, সাথে দেখা দিল চামড়ার নানান অসুখ। এমনই সব অসুবিধার সন্মূখীন হতে হতে কৃষকরা সেই আদি অকৃত্রিম প্রকৃতির উপরই নতুন করে নির্ভর করতে লাগলেন, তাঁরা বিভিন্ন জৈব কৃষি সংক্রান্ত ট্রেনিং নিয়ে নিজ নিজ জমির ফসলে জৈবসার ও কীটনাশকের প্রয়োগ ঘটাতে লাগলেন। এখন কৃষকরা অনেকেই নিজের জমিতে গোবর সার বা কমপোষ্ট (compost) এর মতো প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহার করছেন রাসায়নিক বা কেমিক্যাল সারের পরিবর্তে। এছাড়াও একই জমিতে বিভিন্ন ফসল চক্রাকারে পরিবর্তন করে চাষ করে মাটির স্বাভাবিক পুষ্টিগুন ধরে রাখার অভ্যাস করছেন কৃষকেরা। আগাছা নির্মূল করতে মাটির ও মাটির আর্দ্রতা রক্ষা করতে বর্তমানে বহু চাষী খড় ও কাঠের গুঁড়া জমির ফসলের সারির মধ্যে মধ্যে বিছিয়ে রাখেন, এবং গাছের পোকা লাগা থেকে রক্ষা করার জন্য প্রকৃতিতেই পোকার শত্রু যে সমস্ত কীটপতঙ্গ তাদের ওপর নির্ভর করেন।

রাসায়নিক সারের ক্ষতিকারক দিক গুলি:

প্রাথমিক ভাবে উচ্চফলন ও উন্নত ফসল দেখে রাসায়নিক সারকে মুসকিল আসান ভেবে নিলেও, সময়ের সাথে তার ক্ষতিকারক চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে যায় –

মাটির ভঙ্গুরতা হ্রাস:

দীর্ঘদিন ধরে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে মাটির ভঙ্গুরতা নষ্ট হতে থাকে, কারণ রাসায়নিক সারের উপাদানের মধ্যে প্রধানত সালফিউরিক ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড থাকে যা মাটির সংস্পর্শে এসে মাটির কণাগুলিকে গলিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়া দিনের পর দিন চলতে থাকলে বৃষ্টির জল মাটির ভেতরে প্রবেশ না করে ধুয়ে বেরিয়ে যায়, কারণ মাটির কণাগুলি ক্ষয়ে গেলে মাটির জলধারনের ক্ষমতা কমে যায়। আবার একইরকমের ফসল দিনের পর দিন একটি জমিতে চাষ করলে ভূমির স্বাভাবিক পুষ্টি উপাদানগুলি নষ্ট হতে

থাকে, সময়ের সাথে সাথে। এই রকম একটি জমির উৎপাদনশীলতা বাড়াবার জন্য কৃষক যদি রাসায়নিক সার ব্যবহার করে তবে তা গাছের অর্থাৎ শষ্যের বিকাশের জন্য যে সমস্ত অপরিহার্য ক্ষুদ্র পুষ্টি উপাদানগুলি থাকে যাদের অভাবে ফলন কম হয় সেগুলিকে পুনরায় নতুনভাবে সরবরাহ করতে পারে না কারণ এই সার কেবলমাত্র মাটির নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের অনুপাত বৃদ্ধি করে। তাই অতি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের অভাবে মাটির ফলনক্ষমতা কমতে থাকে।

মাটিতে বসবাসকারী অনুজীব এ উপর প্রভাবঃ

আজোতবাক্যর মাটিতে নাইট্রোজেন এর পরিমান বৃদ্ধি করে

কিছু কিছু রাসায়নিক সার অ্যাসিডিক বা অম্ল হওয়ার ফলে তা মাটির সংস্পর্শে দীর্ঘদিন ধরে এলে মাটির PH Value বা অম্ল-ক্ষারকের মান পরিবর্তিত হয় এবং যেহেতু মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন ধরনের অনুজীবগুলি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল হয় তাই মাটির চরিত্র যদি বদলে যায় অর্থাৎ আম্লিক বা অ্যাসিডিক হয়ে ওঠে তবে অনুজীবদের সংখ্যা দৃষ্টান্তমূলক ভাবে হ্রাস পেতে থাকে। কৃষিগবেষকরা লক্ষ্য করেছেন রাসায়নিক সারের নিয়মিত ব্যবহারে  পোকামাকড়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং উপকারী মাইক্রো organism (যারা গাছের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে) এর সংখ্যা কমতে থাকে।

ভূগর্ভস্থ জলদূষণ:

রাসায়নিক সার মাটিতে থাকা জলের সাথে চট করে গুলে যায়। এর কিছুটা গাছের মধ্যে চলে যায় আর বেশীরভাগ অংশটাই মাটির নিচে চুঁইয়ে ভূগর্ভস্থ জলস্তরে পৌঁছে গিয়ে ওই জলের সাথে মিশে জলকে দূষিত করে তোলে। চিকিৎসকদের মতে যে সমস্ত মানুষজন কৃষিক্ষেত্রের কাছে বসবাস করে, অর্থাৎ রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা হয় যে সব জমিতে, সেই মানুষদের নানারকম শারিরীক অসুবিধা ও চামড়ার অসুখ দেখা যায়।

জৈবসার কিভাবে মাটিকে উন্নত করে?

মটরশুটি গাছ

মাটিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগের ফলে উদ্ভুত নানা রকম ক্ষতিকারক প্রতিক্রিয়া দেখে সারাপৃথিবীর বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা পৃথিবীতে জৈব সারের উন্নতি নিয়ে নিরন্তর গবেষণা চালাচ্ছেন। তাঁরা প্রকৃতিবান্ধব জৈব সার ও মিশ্রসার তৈরী করছেন এবং সেগুলি প্রয়োগ করে মাটির পুষ্টি উপাদান গুলিকে কয়েকগুন বাড়িয়ে তুলছেন কোনো রকম রাসায়নিক ছাড়াই। এছাড়াও কৃষি বিজ্ঞানীরা কিছু অবূর্দযুক্ত উদ্ভিদ (যেমন ডাল, মটরশুটি, রাজমা ও সয়াবীন জাতীয় উদ্ভিদ) শস্যের সাথে সাথে লাগাতে বলেছেন জমিতে কারণ এই জাতীয় উদ্ভিদ মাটির নাইট্রোজেনের পরিমান বাড়িয়ে দেয়। এই জাতীয় উদ্ভিদ মাটিতে থাকা Rhizobia bacteria এর সাথে একটি পারস্পরিক মিথোজীবী (পারস্পরিক নির্ভরতা) সম্পর্ক তৈরী করে যা নাইট্রোজেন ফিক্সেসন বা নাইট্রোজেন স্থায়ীকরণ পদ্ধতিতে মাটিকে নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ করে তোলে। এছাড়াও জৈব সারের প্রয়োগের ফলে Genetically Modified Food (GMOs) অর্থাৎ জিনগতভাবে পরিবর্তিত খাদ্যে থেকে দূরে থাকা যায়। কারন এই ধরনের খাদ্য স্বাস্থের পক্ষে ক্ষতিকারক। তাই জৈবসার নিয়ে প্রচার বাড়ানো দরকার। কারণ প্রকৃতির জন্য প্রাকৃতিক উপাদান ই শ্রেষ্ঠ এবং নিরাপদ।