বিষন্নতা, ঠিক যেন জলে তলিয়ে যাওয়ায় মতো এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি!
কলমে-অরুনিতা ব্যানার্জী, অনুবাদ ও অক্ষরদানে- মোনালিসা মহান্ত, নিউক্র্যাড হেলথ ডেস্ক, মার্চ 10, 2019
বিষন্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা জীবন থাকতেও, প্রতিদিন মরণের সাথে সংগ্রাম করতে থাকেন। আসুন না জেনে নিই বিষণ্ণতার খুঁটিনাটি। একজন দায়িত্বশীল, বিবেকবান সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন নাগরিক হয়ে উঠি। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বিষন্ন মানুষগুলোর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই, হয়তো আমরা এভাবেই বহু মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারি।
আমি সাঁতার কাটতে পারি না। কল্পনা করুন যে আপনিও পারেন না। সাথে এও কল্পনা করুন যে আপনি জলের মধ্যে পড়ে গিয়ে, ধীরে ধীরে জলের তলায় তলিয়ে যাচ্ছেন! আপনার ফুসফুস ক্রমশই জলে ভর্তি হয়ে আসছে। ‘তারা’ বলছে যে এটি এক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত সময় নিতে পারে। কিন্তু, ‘তারা’ কে? ‘তারা’, যাদের আপনি দেখতে এবং শুনতে পাচ্ছেন এবং ‘যারা’ জলের তীরেই দাঁড়িয়ে আছে।
যখন আপনি সম্মুখের কিছু ধরতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, ‘তারা’ কিনারাতেই দাঁড়িয়ে আছে। আপনি কিছুতেই কিছু ধরতে পারছেন না, কিন্তু আপনি ডুবতেও চান না! সম্ভবত, ‘তারাও’ আপনাকে মরতে দিতে চায় না। ডুবে যেতে যেতে ই, আপনি তাদের চিত্কার করে বললেন- “কেউ কি সাহায্য করতে পারো!” আপনি শুনতেও পেলেন ‘তাদের’ কেও বলছে “কেউ একটি দড়ি ছুঁড়ে ওকে বাঁচাও!” তারপর সেই কণ্ঠস্বর টিও দূরে সরে যেতে যেতে ক্রমশ বিলীন হয়ে আসলো।
কি অদ্ভুত, যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি না? একজন হতাশাগ্রস্ত বা ডিপ্রেসড ব্যক্তি ঠিক এমনটাই অনুভব করেন।
যখন একজন সুস্থ ব্যক্তি, একজন ডিপ্রেসড ব্যক্তিকে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ক্রমশই জ্ঞান দিয়ে থাকে তখন তাদের কাছে এটা অসহ্য হয়ে দাঁড়ায়।
আসলে এমনটা হয়ে থাকে কারণ তাদের প্রিয় মানুষগুলো বা কাছের মানুষগুলো সাহায্য করতে চাইলেও, ডিপ্রেসড ব্যক্তির মানসিক পরিস্থিতিটি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে না। আবার ডিপ্রেসড ব্যক্তিটিও এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না, কারণ তিনি তখন ডিপ্রেশন এর মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তার কাছে জানাই নেই কিভাবে এই মানসিক অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
বিষণ্নতা, মারাত্মক হতাশা এবং নৈরাশ্যের সংমিশ্রিত অনুভূতি। বর্তমানে বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়ে পড়া একটি ক্রমবর্ধমান জনস্বাস্থ্য সমস্যা। এবং তার থেকেও বড় সমস্যা হলো আমরা বিষন্ন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে পারি না, আর তাই তাদেরকে সাহায্যও করতে পারি না। ক্রমশ অবসাদে এবং একাকিত্বে ভুগতে ভুগতে বেশিরভাগ মানুষেরই, আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যান্য মানসিক রোগ গুলোর তুলনায়, বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা সব থেকে বেশি। বর্তমান গবেষণায় উঠে এসেছে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতাঃ বর্তমান সমাজে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে এক ভয়ংকর মৃত্যুর থাবা বসিয়েছে।
বিষণ্নতার কারণ কী? আচ্ছা, এ বিষয়ে সঠিক কী কারণ তা নিয়ে নানা মত, মতের বিরোধ রয়েছে।
খুব সাধারন কারণগুলি হল- অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অবসাদ, কর্মক্ষেত্রে অমানবিক চাপ, সহকর্মীদের সাথে বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি, অসুস্থতা, আর্থিক ক্ষতি, সামাজিক অপব্যবহার, এমনকি জেনেটিক কারণ ইত্যাদি।
যখন একজন ব্যক্তি দৈনন্দিন জীবনে, সমাজের সাথে বা সকলের সাথে যুক্তিসঙ্গত বা সঠিক ভাবে, সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে সংযোগ করতে পারে না, তখন এটি স্বাস্থ্যের উপর, মনে, আচরণের প্রভাব ফেলে। এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জ, ভুল বোঝাবুঝি এবং হঠাৎ হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তন এই নানা সমস্যা শুরু হয়। আর এসব সকল সমস্যার শেষপর্যন্ত বিষন্নতার মধ্যে দিয়ে খতম হয়। এই জাতীয় সমস্যাগুলির সংশোধন করে, অনেক ক্ষেত্রেই বিষণ্নতায় আক্রান্ত দের, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়।
বিষণ্নতায় আক্রান্তরা প্রায়শই অচেনাই থেকে যায়। ফলে সঠিক চিকিৎসা অধরাই রয়ে যায় এবং ব্যাপারটা একটু ভুল দিকে পরিচালিত হয়। এর কারন সমাজের উন্নসিকতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যক্তিদের ‘পাগল’ তকমা এঁটে দিয়ে, তাদেরকে মানসিকভাবে আরো দুর্বল করে দেওয়া হয়।
মানসিক চিকিৎসা, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, মনোনিবেশ প্রশিক্ষণ, স্ব-সাহায্য পন্থা এর মাধ্যমেই ডিপ্রেশন এর থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। বিষন্নতার জন্য মনস্তাত্ত্বিক বা মনোবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে পেশাদারী সাহায্য চাওয়া, সমাজের কাছে এখনও নিষিদ্ধ। তবুও, মনস্তত্ত্ববিদরা বিষণ্নতায় আক্রান্ত রোগীদের ‘জলে ডুবে যাওয়া’ (বিষন্নতার ডুবে যাওয়া) থেকে বিরত রাখতে ‘সাঁতার কাটার'(মুক্তি) পদ্ধতি শেখান, তা কার্যকর বলেই প্রমাণিত হয়েছে। সুস্থ জীবনযাত্রা, সহকর্মীদের সহযোগিতা, কম মানসিক চাপ, নিয়মিত যোগাভ্যাসের মাধ্যমে মানসিক চাপ কম করে, বিষন্নতার কবল থেকে নিজেদের ও আক্রান্তদের রক্ষা করতে পারি। আমরা সমাজবদ্ধ জীব, সামাজের অংশ হিসেবে, একজন বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তির মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব কিছুটা আমাদেরও বটে। স্টিফেন হকিং বলেছেন, “সমালোচনা করার পরিবর্তে তাদের সাহায্য করুন; তাদের বোঝা হালকা করার জন্য, তাদের সাথে কথা বলুন”।
কাছের মানুষগুলোর একটি সামান্য ফোন কল, বা SMS, কখনো একটি কার্ড প্রেরণের মতো খুদ্র ও তুচ্ছ কাজগুলি ই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ম্যাজিকের মতো কাজ করে। যেহেতু প্রত্যেক ব্যক্তিই ভিন্ন এবং প্রত্যেকের নিজস্ব একটি সত্ত্বা আছে, তাই হয়তো আপনার এই ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপগুলিই একজনকে ‘ডুবে যাওয়ার’ পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন, একটি জীবন বাঁচান!