নিম্নমানের জীবনযাত্রা ও ক্রমবর্ধমান নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারে ডিজিজ!
নিউক্র্যাড হেলথ বাংলার একটি নিজস্ব প্রতিবেদন, কলমে শুভ্রা, অনুবাদ ও অক্ষরদানে-মোনালিসা মার্চ 24, 2019
নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষ প্রতিনিয়ত কষ্ট পেয়েই চলেছেন।
ধীরে ধীরে, লিভার ডিজিজ(বিশেষত ফ্যাটি লিভার) সমাজের বুকে একটা বড় ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি আপনি কোন সামাজিক অনুষ্ঠান বা আড্ডায় যান, দেখবেন লোকজন খাবার সম্পর্কে যেন একটু বেশিই সর্তক , যাতে কোন লিভার ঘটিত জটিলতার না সৃষ্টি হয়। কিম্বা দেখবেন আপনার বেশিরভাগ চেনা মানুষই লিভার ডিজিজ বা হেপাটিক স্টিটোসিস-এ ভুগছে। এটি একটি অত্যন্ত বিপদজনক শারীরিক অবস্থা যেখানে রোগীর যকৃত কোষে অতিরিক্ত চর্বি জমা হয়।
যকৃত মানুষের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা প্রতিদিন গ্রহণ করা খাবারের পরিশুদ্ধিকরণ করে। এছাড়া এটি বাইল(পিত্ত) ক্ষরণ করে ও রক্ত তঞ্চনে সাহায্যকারী একটি প্রোটিন তৈরি করে। এই যকৃতে ফ্যাট জমতে শুরু করলেই দেখা দেয় নানা রকমের জটিলতা। ক্ষেত্রে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করে কারণ; যকৃৎ কোষে 5 শতাংশের অধিক চর্বির পরিমান থাকলে তবেই একজন হেপাটোলজিস্ট এই রোগ নির্ণয় করতে পারে। যদিও সঠিক জীবনযাত্রা, ওজন কমানো, ব্যায়াম, সঠিক খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি করে এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু শেষ দশায় স্থায়ী ক্ষত, এমনকি যকৃত ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
বিভিন্ন প্রকার ফ্যাটি অ্যাসিড:-
ফ্যাটি লিভার আবার দুই প্রকারের হতে পারে- অ্যালকোহল মুক্ত ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD) এবং অ্যালকোহলযুক্ত ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (ALD)। NAFLD শুনলেই বোঝা যায় যে এই ধরনের ফ্যাটি লিভার কিন্তু মদ্যপানের সঙ্গে বা অ্যালকোহল জাতীয় কোন কিছু পানীয় গ্রহণ গ্রহণ করার জন্য হয় না। তাই এটি যে কোন স্তরের বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই হতে পারে, বিশেষত 40-50 বছর বয়সের মানুষই NAFLD তে আক্রান্ত হতে পারে।
NAFLD আবার কিছু উপ-বিভাগ আছে।
এক হল সাধারণ ফ্যাটি লিভার, ধরনের রোগীর যকৃতে কোনরকম ক্ষতি ছাড়া ঐ প্রচুর পরিমাণ ফ্যাট জমে যায়। আরেক ধরনের হল নন অ্যালকোহলিক স্টেটোহেপাটাইটিস (NASH) এই ধরনের ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে রোগীর যকৃতে প্রচুর পরিমাণ ফ্যাট জমে গিয়ে ফুলে ওঠে যন্ত্রণা এবং যকৃতে সমূহ ক্ষতি করে। বেশিরভাগ সময় শেষ পর্যন্ত স্থায়ী ক্ষতির, সিরোসিস, ক্যান্সারের আকার ধারণ করে। NAFLD তে আক্রান্ত 20% রোগীর ক্ষেত্রে অ্যালকোহলিক স্টেটোহেপাটাইটিসই দেখা যায়।
অ্যালকোহল রিলেটেড ফ্যাটি লিভার অত্যন্ত জটিল একটি অবস্থা। এক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই রোগীর প্রথমদিকে কিছু বুঝতে পারেন না, কিন্তু পরের দিকে যখন ফুলে যায় তখন অত্যন্ত যন্ত্রণা যন্ত্রণায় ভুগতে থাকে। এবং সাথে সাথেই যকৃতের উপরের অংশ খুব অস্বস্তি হয়। তবে হ্যাঁ যদি এই ধরনের ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে রোগী শেষ পর্যায়ে না পৌঁছে যায়, তাহলে কিন্তু এই রোগের থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে জীবনযাত্রার মানকে আরও উন্নত করতে হবে, সাথে অ্যালকোহল জাতীয় তরলের থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকতে হবে। অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ও আবার দুই ধরনের হতে পারে। এক হলো অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস, এই ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির যকৃত ফুলে ওঠে ও জন্ডিসের বিভিন্ন লক্ষণ গুলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। রক্তে বিলিরুবিন এর মাত্রা খুব বেশি বেড়ে যায়। আরেক প্রকার হল অ্যালকোহল সিরোসিস, এই ক্ষেত্রে রোগাক্রান্ত ব্যাক্তিদের যকৃতে ক্ষত তৈরি হয়, যার ফলে যকৃতে প্রচুর পরিমাণ তরল জমা হতে শুরু করে, সাথে পিত্তথলির বৃদ্ধি দেখা যায়। শেষ পর্যায়ে, এটি লিভারের কার্য ক্ষমতা সম্পূর্ণ ভাবেই নষ্ট করে দেয়।
এই নিবন্ধটি NAFLD এর উপর ভিত্তি করে আলোচনা করা হয়েছে।
NAFLD-এর লক্ষন:-
NAFLD তে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যে সমস্ত লক্ষণগুলি দেখা যায় সেগুলো হলো,
- বর্ধিত লিভার।
- ক্লান্তি এবং অবসাদ।
- পেটের উপরের ডান দিকে অস্বস্তি ও ব্যথা।
নন-অ্যালকোহলিক স্ট্যেটোহেপাইটিস এবং সিরোসিসের লক্ষনগুলো নীচে উল্লেখ্য করা হল।
- অ্যাসাইটিস বা পেটে জলজমে যাওয়া।
- ত্বকের নীচের রক্তবাহী নালীগুলি ফুলে যাওয়া।
- পিত্তথলির বৃদ্ধি।
- হেপাটাইটিস বা জন্ডিস, দেহে বিলিরুবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায় ফলে চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে যায়।
কাদের NAFLD তে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি?
ব্যক্তিরা স্থূলতা , ইনসুলিনে প্রতিরোধী (কোষগুলি ইনসুলিন হরমোন উপস্থিতিতেও গ্লুকোজ শোষণ করতে পারে না), প্রিয় ডায়াবেটিক, টাইপ 2 ডায়াবেটিক রোগী, হাইপোথাইরয়েডিজম, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম, নীদ্রাহীনতা, হিপোপিটুইটারিজম , এবং উচ্চ কলেস্টেরল সমস্ত রোগে আগে থেকেই ভুগতে থাকা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে NAFLD ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
NAFLD তে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কি কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়?
এই ধরনের ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত ব্যক্তি দিয়ে যদি সঠিক চিকিৎসা না হয় তাহলে এদের খাদ্যনালী ফুটে ওঠে ওঠে এবং ক্ষতের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় খাদ্যনালীর অতিরিক্ত ফুলে ওঠায় ক্ষতস্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যকৃতের পরিপাকক্রিয়া পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায় এবং একদম শেষ দশায় ওই ব্যক্তি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
হেপাটলজিস্টরা কিভাবে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্তদের চিহ্নিত করেন?
চিকিৎসকেরা প্রথমে রোগীদের সমগ্র সমস্যাগুলির ভালো করে জেনে নেওয়ার পর বিশ্লেষণ করেন, NAFLD র লক্ষণগুলি বহিঃপ্রকাশ হয়েছে কিনা। তারপর তিনি অ্যালানিন অ্যামিনোট্রান্সফারেজ (ALT) এবং অ্যাসপারটেট অ্যামিনোট্রান্সফারেজ (AST) এর পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য রক্ত পরীক্ষা করাতে দেন। পরীক্ষায় যদি দেখা যায় ALT ও AST এর পরিমাণ খুব বেশি আছে, তখন তিনি সিটি স্ক্যান ও MRI করার পরামর্শ দেন। অনেক সময় লিভারে বায়োপ্সি করার ও প্রয়োজন পড়ে।
NAFLD জন্য চিকিৎসা কী কী?
এখন পর্যন্ত NAFLD এর জন্য কোন মেডিকেল বোর্ড অনুমোদিত ঔষধ নেই। হেপাটোলজিস্টরা জীবনযাত্রার পরিবর্তন যেমন ওজন কমানো, ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে পরামর্শ দেন।
তাহলে আপনি তো জেনেই গেলেন NAFLD সম্পূর্ণভাবে সারিয়ে তোলা যায়। তাই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বজায় রাখার চেষ্টা করুন, নিয়মিত ব্যায়াম বা যোগাভ্যাস করুন এবং সুস্থ থাকুন।