হান্টা ভাইরাসে আক্রান্তের মৃত্যু! আতঙ্কিত হবেন না, গুজব না ছড়িয়ে আমরা হান্টা ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই
সারাবিশ্বে করোনা মহামারীর আকার ধারণ করেছে, আর সমগ্র বিশ্ববাসী মরিয়া হয়ে এর বিরুদ্ধে লড়তে চেষ্টা করছে, তারই মাঝে আবারো হান্টা ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন চীনের ইউনান প্রদেশের এক ব্যক্তি। শানডং প্রদেশ থেকে কাজ করে ফেরার পথে বাসের মধ্যেই মারা যান তিনি। চিকিৎসক কর্তৃপক্ষরা ঐ বাসে উপস্থিত আরো 32 জন সহযাত্রীকেও এই প্যাথোজেন সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেছে। এহেন পরিস্থিতিতে সকলেই ভাইরাসের নাম শোনা মাত্রই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি, চলুন না আমরা বরং হ্যান্টাভাইরাস সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিই।
হান্টা ভাইরাস আসলে কী?
হান্টা ভাইরাস বা অর্থোহন্টা ভাইরাস হ’ল একপ্রকার সিঙ্গেল RNA ভাইরাস, যা বুনিয়াভিরালিস বর্গের অন্তর্গত এবং হান্টাভিরিডি পরিবারের সম্পর্কিত। হো-ওয়াং লি সর্বপ্রথম 1977 সালে এই জীবাণুটি আবিষ্কার করেন। যেহেতু দক্ষিণ কোরিয়ার হান্টান নদীর থেকে এই ভাইরাসটির নামকরণ হয়েছিল হান্টা, সর্বপ্রথম সেখানেই এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছিল।
এগুলি সাধারণত ইঁদুরের দেহে সংক্রমণ ঘটায়, তবে তাদের মধ্যে কোনও অসুস্থতা ঘটায় না। তবে, মানুষ যদি সংক্রামিত ইঁদুরের মল, প্রস্রাব বা লালার সংস্পর্শে আসে তবে তারা হান্টাভাইরাস পালমোনারি সিনড্রোম (HPS) নামে পরিচিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এই ভাইরাসের কিছু স্ট্রেন হেমারেজিক ফিভার উইথ রেনাল সিনড্রোম ডিজিজ (HFRS) অর্থাৎ জ্বর ও প্রসাবের সাথে রক্তক্ষরণ জ্বরও ঘটায়।
মানবদেহে এই সংক্রমন ইঁদুরের সংস্পর্শের এলে তবেই ঘটে, তবে ২০০৫ এবং ২০১৯ সালে দক্ষিণ আমেরিকার অ্যান্ডিস অঞ্চলে মানুষের থেকে মানুষ এর দেহে এই সংক্রমণের ঘটার খবর পাওয়া গিয়েছিলো।
হান্টা ভাইরাসের সংক্রমণের ঘটনাবলী :-
হান্টা ভাইরাস সাধারণত গ্রামাঞ্চলে অর্থাৎ যেখানে বন, খামার এবং চারণভূমির প্রাধান্য রয়েছে সেই সব জায়গায় পাওয়া যায়। এই জায়গাগুলি ইঁদুরদের জন্য আদর্শ আবাসস্থল। তবে অনেক ক্ষেত্রেই, বাড়িঘর, কারশেড এবং কনস্ট্রাকশন এরিয়াতেও ইঁদুরের দৌরাত্ম্য দেখা যায়। সংক্রামিত ইঁদুরের সংস্পর্শে এলে মানুষের ও আক্রান্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
সিন নম্ব্রে প্রজাতির হান্টাভাইরাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় এই রোগের যে সংক্রমণ ঘটায় এবং এই প্রজাতির প্যাথোজেনের হোস্ট ছিল ডিয়ার মাউস (পেরোমাইস্কাস ম্যানিকুলাটাস)।
এছাড়াও, সাদা পায়ের ইঁদুরে (পেরোমাইস্কাস লিউকোপাস) দেহে উপস্থিত নিউইয়র্ক-হান্টাভাইরাসও উত্তর-পূর্ব আমেরিকাতে HPS রোগ ঘটিয়েছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব আমেরিকাতে কটন র্্যাট (সিগমডন হিস্পিডাস) দ্বারা বাহিত ব্ল্যাক ক্রিক হান্টাভাইরাস সংক্রমণ ঘটিয়েছিল।
আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পানামা, প্যারাগুয়ে, চিলি এবং উরুগুয়েতেও বিভিন্ন সময়ে HPS-এ আক্রান্ত হবার ঘটনা দেখা গেছে।
হান্টাভাইরাস পালমোনারি সিনড্রোমের (HPS) লক্ষণগুলি কী কী?
হান্টাভাইরাসের উপসর্গগুলো সাধারণত ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার এক থেকে আট সপ্তাহ পরে রোগীদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে।
এর প্রাথমিক লক্ষণগুলি হল:-
অবসাদ
উরু, পিঠ, কাঁধসহ সারা শরীরে ব্যথা
মাথাব্যাথা
101°F এর চেয়ে বেশি জ্বর
শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া
মাথা ঘোরা
বমি বমি ভাব
বমি ও পায়খানা
ইত্যাদি।
বাড়াবাড়ি পর্যায়ে রোগীর দেহে কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং ফুসফুসে জল জমা ইত্যাদি নানান ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।
ফুসফুসের ভিতরে উপস্থিত রক্তনালীগুলি প্রভাবিত হতে পারে এবং দেহের বিভিন্ন অংশে এই তরল নিঃসৃত হতে শুরু করে। চরম পর্যায়ে ফুসফুসের মধ্যে তীব্র রক্তপাতের কারনে হৃদযন্ত্রের বিকলিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
HPS এমন একটি মারাত্মক রোগ, যাতে মৃত্যুর হার 38 শতাংশ।
হান্টাভাইরাস পালমোনারি সিনড্রোম শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা করা হয়?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগের প্রাথমিক লক্ষনগুলি, সাধারণ ফ্লুয়ের মতোই হওয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্ত করা চ্যালেঞ্জিং। সর্বোপরি, HPS নির্ণয়ের জন্য কোনও কিট বা নির্দিষ্ট কোনো টেস্ট নেই। এই জাতীয় পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা হান্টাভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে কীনা নির্নয়ের জন্য এ স্থানে ইঁদুরের দৌরাত্ম্য এবং শ্বাসকষ্টের সাথে উচ্চ জ্বরের মতো কোনো উপসর্গ আছে কিনা দেখেন।
হান্টা-ভাইরাস পালমোনারি সিনড্রোমের চিকিৎসা পদ্ধতি কী?
HPS এর জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, তাই ডাক্তাররা রোগের উপসর্গগুলি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেই চিকিৎসা করেন।গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে, রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন পড়ে, অনেক ক্ষেত্রেই ICU তেও ভর্তি করতে হয়। চিকিৎসকরা অসুস্থ রোগীদের দেওয়ার জন্য ইনটিউবেশন, অক্সিজেন থেরাপি এবং তরল প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন।