মহামারী চলাকালীন কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেবেন?
সুভাষ বিশ্বাস, নিউক্র্যাড হেলথ বাংলা
বিশ্বব্যাপী মহামারীর মধ্যে চলছি আমরা, এই বিশ শতকের বিশ সালে। ভাইরাস কোভিড ১৯, অচিরেই হয়ত গোটা বিশ্বকে দাঁড় করে দিতে পারে এক ঐতিহাসিক মহামারীর দোড় গোড়ায়। অত্যাধিকভাবে সংক্রামককারীর এই ভাইরাস এখনো পর্যন্ত ছড়িয়েছে বিশ্বের ১৯৯ টি দেশ ও আর্ন্তজাতিক দুটি জাহাজে। মহামারীর সংক্রমণ রুখতে গোটা বিশ্বের বহুদেশ বন্ধ রেখেছে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ঘরবন্দি হয়ে সংক্রমণকে রোধ করতে আহবান জানিয়েছেন বহু দেশের সরকার। সরকারী পরয়ানার নির্দেশকে সবোর্চ্চ মনে করে দরজাবন্দি বহু মানুষ। আর এখানেই হয়ত খেই হারাচ্ছে মানব সভ্যতা।
ঘরে বসে থাকতে কার ভালো লাগে! যেখানে স্বয়ং কবিই বলে গেছেন, “থাকবো নাকো বন্ধ ঘরে দেখবো এবার জগতটাকে”। কিন্তু বন্ধ ঘর ছাড়া উপায় যে আর কিছুই নেই। বর্তমান যুগের দ্রুতগতির সাথে অভ্যস্ত মানুষকে ঘরবন্দি করে আটকে রাখলে, কুফল তো মিলবেই। আর সেখানেই শারীরিক স্বাস্থ্যের সাথে সাথে মানব সভ্যতা হারাচ্ছে মানসিক ভারসাম্যও। খবরের চ্যানেল খুললে একদিকে যেমন ক্রমাগত বেড়েই চলেছে করোনোর সংক্রমণ, তেমনই অন্যদিকে ঘরবন্দি- এই দুইয়ের মাঝে নাজেহাল হয়ে পড়েছে মানবজাতির মানসিক সাম্রাজ্য।
আসুন দেখে নিই, এই কঠিন অবস্থায় নিজেদের মন ও স্বাস্থ্য ঠিক রাখার কিছু উপায় :
১. ভারতবর্ষ ও বৈদেশিক বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই শুরু করেছে “ই-লার্নিং”। এমনকি বাদ যায়নি বিদ্যালয়ও। ১৫দিনের বেশি ছুটিকে সাংঘাতিক ঘাটতি হিসাবে মেনে নিয়ে শিক্ষকেরা ঘরে বসেই নির্দিষ্ট একটি সময়ে “ই-লার্নিং” এর মাধ্যমে শুরু করেছেন পড়াশোনা। বিদ্যালয়ের নিজস্ব পোর্টালেই পাওয়া যাচ্ছে বই। আবার বিদ্যালয় থেকেই দেওয়া হচ্ছে বাড়ির কাজ। ঘরে বসেই যেন একটি স্কুল চলছে নিয়ম মেনে। সমস্তটাই ইন্টারনেট ভিত্তিক হওয়ায় কাউকেই যেতে হচ্ছে না বাড়ির বাইরে, নিয়মিত কাজের নিরিখে প্রাণচ্ছোল রয়েছে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ও তাদের মানসিক স্বাস্থ্য। ঘরবন্দি এই পরিস্থিতিকে কাজ লাগানোর অন্যতম সেরা উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এই “ই-লার্নিং”।
২. ভারতীয় শাস্ত্র বিধি সেই ঐতিহাসিক প্রাচীনকাল থেকে মানসিক সংযম রধে রাখতে নিয়মিত তালিকায় রেখেছে – ধ্যান ও যোগ ব্যায়াম। যদিও ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও ব্যস্ততম এই যুগে দাঁড়িয়ে ধ্যান ও ব্যায়াম আমাদের নিয়মিত তালিকা থেকে প্রতিনিয়ত চলে গেছে বাদের খাতায়। তবুও এই কঠিন সময় দুর্বল মনকে শক্ত করতে “ধ্যান ও ব্যায়াম” এই দুইয়েররই পরামর্শ দিচ্ছে স্বয়ং ডাক্তারমন্ডলীরা। মানসিক পীড়ন থেকে মুক্তি পেতে নিয়মমাফিক করুন সুখাসন, উত্তানাসন, সসংগাসন, ও বর্জ্রাসন। এছাড়া ধ্যানের দ্বারা দূর হবে উদ্বেগ, হতাশা, ও মানসিক যন্ত্রণা। নিয়ম মত ধ্যান আপনার মনকে সচল ও তরতাজা রাখবে। তাই এই লকডাউনে নিয়মিত ধ্যান করুন, সাথে মন্ত্রপাঠও করুন (১,২)।
৩. গান শিখতেন একসময়? নামিয়ে ফেলুন না আবার হারমোনিয়ামটা। নাচতেন একসময়? তাহলে খুঁজে বার করে আবার পড়ুন না নুপূরটা। কিংবা যদি ছবি আঁকার শখ ছিল, কলেজে পড়তে ভেবেওছিলেন আর্টিস্ট হবেন, তবে আর দেরী করবেন না; এখনই সঠিক সময় আপনার পুরোনো শখকে আবার জাগিয়ে তোলার ও নতুন কিছু করার, এবং অবশ্যই ঘরের মধ্যে থেকে। অনেকেই নতুন নতুন রান্নার খোঁজ করেন, তৈরি করে ফেলুনই না নতুন কিছু এই লকডাউনে। নতুন স্বাদে ভরিয়ে দিন কর্তা/গিন্নীর মন। বাড়ির কচিটা যে প্রতিদিন আপনার কাছে আসত সবজি কাটার সময় বয়না ধরতো, সময়ের অভাবে তাদের তো সবসময়ই এরিয়ে যেতেন, এখন তাদেরও শেখান বাড়ির কিছু কাজ আর আপনারও করুন। দেখবেন নতুন নতুন কিছু জিনিস অজান্তেই নিজের ভালোলাগায় হচ্ছে আবিস্কার।
৪. বাড়ি বসে সারাদিন ফোন হাতে ঘেটে চলেছেন সোশ্যাল মিডিয়া? ভাবছেন এই কোভিড ১৯ সম্পর্কে সঠিক তথ্য সবার আগে পেয়ে ছড়িয়ে দেবেন কাছের মানুষটির কাছে? আপনারা ভাবনা ভুল নয়, কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে সব মিথ্যেতথ্য বা ফেক নিউজ সব চেয়ে বেশী প্রচার পায় এই সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি থাকার থেকে বই পড়ুন, এই সময়ে বইয়ের সাথে সাথে বাড়ান আপনার ঞ্জানের ভান্ডার, এবং বাড়ির কচিকাচাদের মধ্যে সঞ্চার করুন বই পড়ার আগ্রহ। আর কোভিড ১৯ সম্পর্কে নতুন পুরোনো সব খবরা খবর পেতে চোখ রাখুন “মিনিস্ট্রী অফ্ হেল্থ” ও “ফ্যামিলী ওয়েলফেয়ার” নামক দুই সংস্থার দ্বারা পরিচালিত পোর্টালে (ভারতীয়); অথবা WHO (World Health Organization) এবং CDC (Centres for Diseases Control and Prevention) -এর দ্বারা চালিত ওয়েবসাইটে, যেগুলিকে যাচাই করে মানুষের সুবিধার্থেই চালানো হয়। নিউক্র্যাড হেলথ ওয়েবসাইট টি ও আপনারা অনুসরণ করতে পারেন । বিশ্বরূপ ঘোষ, গবেষক, আমেরিকায় কর্মরত, বিশ্বে প্রথম এই স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ওয়েবসাইট টি নিয়ে এসেছেন আমাদের মাতৃভাষা বাংলা তে।
এইভাবেই নিজেকে ব্যস্ত রাখুন, সুস্থ থাকুন, সঠিক চিন্তার মধ্যে থাকুন আর ভয় না করে ঘরে থাকুন। মনে রাখবেন, শান্ত সময়েই সঠিক চিন্তা মাথার থেকে বের হয়।
এখন আমরা এ সম্পর্কে আরও জানব ভারতের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ তনয় মাইতি,এমস (AIIMS)ভুবনেশ্বর,থেকে।
“COVID-19 -ঐর পরিচিতি আর শুধুমাত্র শ্বাসকষ্টজনিত রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাল মহামারী হিসেবে আটকে নেই, বর্তমানে এটি বিশ্বব্যাপী মানুষের ভীতির কারণ হয়ে উঠেছে। COVID-19 এর দ্রুত বিস্তার সমগ্র মানবজাতিকে অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, যা এর আগে কখনো দেখা দেয়নি। “কী হবে” বা ‘ এরপর কে আক্রান্ত হবে’- এই নিয়ে মানসিক উদ্বেগ এবং সঠিক কেয়ার, এই দুইই কিন্তু সমগ্র বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শিশু ও বৃদ্ধ, বা স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রে এই মানসিক চাপ অনেক বেশী। তো এইসব ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কী করতে পারেন, জানালেন চিকিৎক তনয় মাইতি:- প্রথমত, এমত পরিস্থিতিতে আতঙ্ক বা ভীতী, বা মানসিক চাপ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, তাই এ সময় মানসিক স্বাস্থ্যকে কোনোভাবেই অবহেলা করবেন না। মানসিক চাপ কমাতে আপনার দৈনন্দিন রুটিন মেনটেইন করার চেষ্টা করুন। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ হলে আপনার কাজগুলো করতে পারেন, সঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া করুন, সাথে পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম এগুলোর দিকেও নজর দিন। একটি বিভিন্ন শখ বা হবি গুলোর জন্য কিছুটা সময় দিন। সাথে বিভিন্ন রিল্যাক্সেশন মেথডগুলি প্র্যাকটিস করতে পারেন। যে অফুরান সময় পেয়েছেন তার সদ্ব্যবহার করুন। যত মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছুটা সময় দিন, বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে নিজেকে আপডেট করুন, কিন্তু আবার অতিরিক্ত আপডেটেড হতে যাবেন না। ভুলভাল তথ্য সংগ্রহ করে এই মহামারী সময়ে আবার আতঙ্ক ছড়াবেন না। একটি শিশু এবং বয়স্ক মানুষ উভয় জন্য বিশেষ যত্ন নিন। তাদের জীবন এবং উদ্বেগ দুই কিন্তু আমাদের চেয়ে অনেক আলাদা, তাই তাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করুন। সর্বোপরি আপনার পরিবারের কোনো সদস্য বা আপনি নিজের বা আপনার চারপাশের কোনো ব্যাক্তির যদি এই মানসিক উদ্বেগের কারনে বিশেষজ্ঞের সহায়তার প্রয়োজন হয়, তাহলে লজ্জা না পেয়ে এবার দেরি না করে অতিসত্বর বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন। সবসময়ই আপনাকে ঠিক থাকতেই হবে এরকম তো ব্যাপার নেই, আমাদের শরীর যদি অসুস্থ হতে পারে, মন ও কিন্তু অসুস্থ হতে পারে!”
উৎস :
১. Yoga for Inner Peace: A Stress-Relieving Sequence
২. Mindfulness Meditation Can Help Relieve Anxiety And Depression
৩. COVID-19
৪. Coronavirus disease (COVID-19) outbreak
৫. Coronavirus Disease 2019 (COVID-19)
৬. Looking after your mental health during the Coronavirus
1 thought on “মহামারী চলাকালীন কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেবেন?”
Comments are closed.