‘মনো’ বা ‘চুম্বন রোগ’ সংক্রমণের প্রবণতা কিশোরদের মধ্যে বেশি হয়
সৌমিত্র রায়, পিএইচডি ফেব্রুয়ারি 14, 2022
মনোনিউক্লিওসিস, যা সাধারণত ‘মনো’ বা ‘চুম্বন রোগ’ হিসাবে পরিচিত, এপস্টাইন-বার ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট সংক্রামক রোগ। এই একই ভাইরাস হার্পিসের জন্যও দায়ী। যদিও প্রাণঘাতী নয়, তবুও অনেকসময় রোগের লক্ষণগুলির নিদারুণ বহিঃপ্রকাশের ফলে প্রায়শই সাধারণ মানুষের সামাজিক মেলামেশায় বিঘ্ন ঘটতে পারে। বাচ্চা বা বয়স্কদের তুলনায় কিশোরদের (১৫-১৭ বছর) মধ্যে এই সংক্রমণের প্রবণতা বেশি হয়।
মনোনিউক্লিওসিসের প্রাদুর্ভাব কতটা ব্যাপক?
মনোনিউক্লিওসিস একটি গুরুতর ভাইরাল সংক্রমণ এবং আমেরিকায় প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ অনুর্দ্ধ ৪০ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এপস্টাইন-বার ভাইরাসের অ্যান্টিবডি উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। এটা দেখা গিয়েছে যে তারা তাদের জীবনের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে। ‘সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-এর তথ্য অনুযায়ী, শিশু বা বৃদ্ধ ব্যক্তিদের তুলনায় তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ‘মনো’র প্রাদুর্ভাব বেশি (২৫%) ঘটে। গবেষণায় উচ্চবিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই লক্ষণগুলি বেশি দেখা গিয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে, লক্ষণগুলি না দেখা যেতে পারে, অথবা এটি এত নুন্যতম হতে পারে যে সংক্রমণ প্রায়শই চেনা শক্ত হয়ে যায়।
কিভাবে মনোনিউক্লিওসিস ছড়ায়?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, মনোনিউক্লিওসিস সংক্রামিত ব্যাক্তি থেকে সুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে মিউকাস বা লালার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাস সাধারণত চুম্বন করার সময় ছড়িয়ে পড়ে এবং এই কারণে এই রোগটি ‘চুম্বন রোগ’ নামে পরিচিত। তবে, সংক্রামিত রোগীর কাশি বা হাঁচির ফোঁটার (ড্রপলেট) মাধ্যমে অথবা খাবার বা খাবারের জিনিসপত্র ভাগ করে নেওয়ার সময়ও এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এটি বছরের যে কোনো সময় ছড়িয়ে পড়তে পারে তবে শীতকালে এবং ফ্লু-এর সময় সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এই প্যাথোজেনের বা ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড (প্যাথোজেনের সংস্পর্শে আসার সময় থেকে রোগের লক্ষণ প্রকাশের সময়) প্রায় চার থেকে আট সপ্তাহ, তাই রোগীরা এপস্টাইন-বার ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার দীর্ঘ সময়ের পরে রোগের লক্ষণগুলি প্রকাশ পায়।
মনোনিউক্লিওসিসের লক্ষণ
মনোনিউক্লিওসিসের লক্ষণগুলি দীর্ঘকালব্যাপী থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিরা দুই মাস পর্যন্ত অসুবিধা অনুভব করে। নীচে এই রোগের সাধারণ লক্ষণগুলি বিস্তারিত ভাবে দেওয়া হল- • জ্বর • গলা ব্যাথা (ফ্যারিঞ্জাইটিস) • লসিকা গ্রন্থী ফুলে যাওয়া বিশেষ করে গলায় ও বাহুমূলে • ফুসকুড়ি • গলায় সাদা দাগ • ক্লান্তি • মাথা ব্যাথা • রাত্রিকালীন ঘাম • শারীরিক দুর্বলতা • স্প্লেনোমেগালি (স্প্লিনের বৃদ্ধি) মনোনিউক্লিওসিসের নির্ণয় অন্যান্য সংক্রমণ এবং মনোনিউক্লিওসিস পর্যায়ভুক্ত আনুষঙ্গিক সংক্রমণ (সেকেন্ডারি ইনফেকশন) নিরাময়ের জন্য মনোনিউক্লিওসিস সংক্রমণ নির্ণয় অপরিহার্য। এখানে এই রোগের সনাক্তকরণের জন্য কয়েকটি পরীক্ষা দেওয়া হল।
শারীরিক পরীক্ষা
ডাক্তার যখন মনো সংক্রমণের সন্দেহ করেন তখন তিনি সংশ্লিষ্ট লক্ষণগুলি যেমন জ্বর, টনসিল এবং লসিকা গ্রন্থী ফুলে যাওয়া এবং যকৃৎ বা প্লিহার বৃদ্ধি হয়েছে কিনা পরীক্ষা করেন। সম্পূর্ণ রক্ত কণিকার গণনা (কমপ্লিট ব্লাড কাঊন্ট) সম্পূর্ণ রক্ত কণিকার গণনার মাধ্যমে রক্তের বিভিন্ন উপাদান যেমন লোহিতকণিকা, শ্বেতকণিকা ও অনুচক্রিকা পরিমাণ ও অবস্থা নির্ণয় করা হয়। রোগের উপসর্গগুলি সহ রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি ‘মনো’ সংক্রমণের ইঙ্গিত দেয়।
মনোস্পট টেস্ট মনোস্পট টেস্ট রক্তের নমুনায় এপস্টাইন-বার ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি পরীক্ষা করে। এটি হেটেরোফাইল টেস্ট হিসাবেও পরিচিত। মনো’র লক্ষণগুলির আবির্ভাবের দুই থেকে চার সপ্তাহ পরে পরীক্ষার ফলাফল আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে পাওয়া সম্ভব। এই পর্যায়ে, রক্তে যথেষ্ট পরিমাণ অ্যান্টিবডি উপস্থিত থাকার ফলে নির্ভুল রিপোর্ট পাওয়া যায়।
মনোনিউক্লিওসিসের চিকিত্সা যেহেতু মনোনিউক্লিওসিস একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ সেহেতু এই রোগের চিকিত্সার জন্য কোন নির্দিষ্ট থেরাপি নেই। অ্যান্টিবায়োটিক এই রোগের ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর হয় না; ডাক্তাররা যখন তাদের অন্য কোন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ সন্দেহ করেন তখনই তাদের অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রচুর পরিমাণে তরল পানীয় গ্রহণ করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া মনোনিউক্লিওসিস সংক্রমণ নিরাময় করতে সাহায্য করে।
মনোনিউক্লিওসিস থেকে কোনো শারীরিক জটিলতা আসতে পারে কি?
মনোনিউক্লিওসিস থেকে কিছু গুরুতর জটিলতা আস্তে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ভাইরাল সংক্রমণে আক্রান্ত ব্যক্তির প্লীহা বা যকৃৎ আয়তনে বৃদ্ধি পায়। অত্যন্ত গুরুতর অবস্থা হলে, প্লীহা ফেটে গিয়ে উপরের পেটের বাম পাশে দুঃসহ ব্যথা অনুভূত হতে পারে। অন্যান্য কম লক্ষ্যণীয় জটিলতাগুলি হল-জন্ডিস, অ্যানিমিয়া, অথবা থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া (অনুচক্রিকার সংখ্যা হ্রাস পাওয়া)।
মনোনিউক্লিওসিস প্রতিরোধ করার কোনো উপায় আছে কি?
এপস্টাইন-বার ভাইরাস, অর্থাৎ মনোনিউক্লিওসিসের জন্য দায়ী প্যাথোজেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংক্রামিত ব্যাক্তির লালার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। চুম্বন থেকে বিরত থাকা, খাদ্য বা বাসন ভাগাভাগি না করা ভাইরাস ছড়িয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। সুস্থ্য ব্যক্তিদের খাবার আগে ভালো করে হাত ধোওয়া উচিত এবং ব্যক্তিগত জিনিসপত্র কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করা বা দেওয়া উচিত নয়। পরিশেষে, আমরা বলতে পারি যে মনোনিউক্লিওসিস কয়েক সপ্তাহব্যাপী স্থায়ী হতে পারে, তাই যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্রাম নেওয়া উচিত এবং রোগের সময় ধৈর্য ধরতে হবে।