বাদুড়ের দেহ করোনা ও বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের ভান্ডার – বাদুড়ের স্বতন্ত্র ইমিউনিটি সিস্টেম
নিউক্র্যাড হেলথ বাংলা এপ্রিল 17, 2020
বর্তমানে COVID-19 মহামারী সম্পর্কে সকলেই অবগত, গত 16 ই এপ্রিল পর্যন্ত, 2,182,197 জনেরও বেশি লোককে সংক্রামিত করেছে এবং প্রায় 145,521জনের বেশি জীবন কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু এটা ছাড়াও বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ভাইরাল সংক্রমনের কথাগুলো কী মনে আছে?
2003 সালে সিভিআর অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোমে (SARS) 8098 আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে 774 জনের মৃত্যু হয়। বা, 2015 সালে মিডল ইস্ট রেস্পিরাটরি সিনড্রোমের কারনে (MERS), যে 492 জনের মৃত্যু হয়, তা মনে আছে কী? অথবা, পশ্চিম আফ্রিকাতে ইবোলা ভাইরাসের কারনে 2014-2016 সালের মধ্যে 28,616 জন ব্যাক্তির মৃত্যুর খবর।
কিংবা, এই কিছুদিন আগেই 2018 সালে কেরলে নিপা ভাইরাসের কারণে আক্রান্ত হয়ে 17 জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, সেইখবর।
আপনি কি এই সব ঘটনাগুলির মধ্যে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন? একদমই ঠিক ধরেছেন, হ্যাঁ, উপরের সমস্ত ক্ষেত্রেই, মানবদেহে সংক্রমণের ক্ষেত্রে বাদুড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
সাম্প্রতিক ইতিহাসের বেশিরভাগ মহামারীতেই হোস্ট হিসাবে বাদুড় কাজ করেছিল:-
উপরে আমরা যে সমস্ত ভাইরাসগুলো নিয়ে আলোচনা করলাম সেগুলি সবগুলোই ছিল জুনোটিক এবং বাদুড়ই ছিল তাদের প্রাথমিক হোস্ট। গবেষকরা মনে করেন, বর্তমানে বাদুড়ের দেহ-ই সবথেকে বেশী প্যাথোজেনের আধার। বর্তমানে বাদুড়ের থাকার জায়গার অভাব ঘটায়, এই উচ্ছৃঙ্খল উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রজাতির প্রাণীগুলি প্রায়শই মানুষের আবাসস্থল এর কাছাকাছি চলে আসছে।
যেহেতু তারা তাদের শরীর নানাবিধ প্যাথোজেনিক ভাইরাসগুলির আবাসস্থল, তাই যখনই তারা মানুষের বা অন্য কোন প্রাণীর খুব কাছাকাছি আসে, তখনই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেক গুণে বেড়ে যায়। আরে ভাবেই মানুষ সংক্রামিত হয়ে পড়ে ও বিভিন্ন ধরনের প্যাথোজেন ঘটিত মহামারী দেখা যায়।
এই উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীটির সম্পর্কে কিছু সাধারণ তথ্য জেনে নেওয়া যাক:-
আজ পর্যন্ত, ট্যাক্সোনমিস্টরা বিশ্বে বসবাসরত 1300 টিরও বেশি প্রজাতির বাদুড়কে চিহ্নিত করেছে।
তারা কাইর্প্টেরা (Chiroptera) বর্গের অন্তর্গত, এবং উপবর্গ হল ইয়েনপেট্রোকাইর্প্টেরা এবং ইযয়েঙ্গোকাইর্প্টেরা। এরা মূলত পেট্রোপোডিয়ি এবং রাইনোলোফিডিয়ি গ্রোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
আমাদের গ্রহে ঘুরে বেড়ানো দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণী হল এই বাদুড়। ঠান্ডা মেরু অঞ্চল এবং গরম মরুভূমি ব্যতীত আপনি পৃথিবীর সর্বত্রই এদের দেখতে পাবেন। এরা সামাজবদ্ধ প্রানী এবং কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার সদস্য একসাথে দলবদ্ধভাবে বসবাস করতে পছন্দ করে।এগুলি বীজ ছড়িয়ে দেওয়া, ফুলকে পরাগায়িত করতে সাহায্য করে এবং তাদের খাদ্যাভাসে এক বিরাট বৈচিত্র্য প্রকাশ করে এবং যা পরোক্ষভাবে আমাদের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাদুড়ের স্বতন্ত্র ইমিউনিটি সিস্টেম:-
বাদুড়ের দেহে এক অনন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে, যা তাদেরকে বিভিন্ন গ্রুপের ভাইরাসের উপযুক্ত আবাসস্থল করে তোলে। তারা অত্যন্ত সক্রিয় প্রাণী, শিকার এবং নতুন আবাসের সন্ধানে তারা ক্রমাগত উড়তে থাকে। ফলস্বরূপ, এই স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহের তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং বিপাকীয় হার থাকে। যা তাদের একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতে সহায়তা করে।
যেহেতু তাদের দেহের তাপমাত্রা সবসময় খুব বেশি থাকে, তাই বাদুড়ের দেহে ভাইরাল সংক্রমণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। যা তাদের কোনো লক্ষণ ছাড়াই, ভাইরাসের উপযুক্ত বাহক করে তোলে।
সুতরাং, এই প্রাণীগুলির শরীরে সবসময়ই প্রচুর পরিমাণে ভাইরাল লোড থাকে। তাদের দেহের এই স্বতন্ত্র ইমিউনিটি সিস্টেম থাকায় তারা নিজেরা সংক্রামিত না হয়েও সফলভাবে অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে।
বাদুড়ের দেহে প্রচুর পরিমাণে ইন্টারফেরন উপস্থিত থাকে যা তাদের ইমিউনিটি সিস্টেম কে স্বতন্ত্র করে তোলে:-
বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্টের অরিঞ্জয় ব্যানার্জি এবং তার সহকর্মীরা সম্প্রতি তাদের গবেষণায় খুঁজে পেয়েছেন, বাদুড়ের দেহে প্রচুর পরিমাণে ইন্টারফেরন (IFNs) উপস্থিত রয়েছে যা তাদেরকে বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধী করে তোলে।
বাদুরের দেহ কোষ পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তাদের টাইপ 1-IFNs এর পরিমাণ, মানুষের তুলনায় অনেক বেশি, যা ভাইরাল রেপ্লিকেশন ক্ষমতা নষ্ট করে, ভাইরাসকে বিনষ্ট করতে সাহায্য করে।
বড় বাদামী বাদুড়ের দেহকোষে পরীক্ষা করে দেখা গেছে বাদুরের দেহে ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইনস্ এর পরিমাণ অনেক কম। এই সাইটোকাইন আরো অন্যান্য ইমিউন সেল দ্বারা ঘেরে থাকে এবং কোথাও ইনফেকশন হলেই সেখানে গিয়ে সেই ইনফেকশন নির্মূল করতে সাহায্য করে, যার ফলে সেটা আর ছড়িয়ে পড়ত পারে না।
কিন্তু তাদের দেহে এই সাইটোকাইনসের পরিমাণ কম থাকায়, তাদের দেহে উপস্থিত ভাইরাসে সহজেই অন্যান্য প্রাণীর দেহে ছড়িয়ে পড়ে।
তাহলে আমরা বাদুড় সম্পর্কে ও স্বতন্ত্র ইমিউন সিস্টেম সম্পর্কে আমরা বেশ কিছু তথ্য জানলাম। জানলাম কেন তারা বিভিন্ন প্রকার প্যাথোজেনিক ভাইরাসের আবাসস্থল হয়ে উঠেছে, বা কীভাবে ভাইরাল ইনফেকশন ছড়িয়ে দিচ্ছে।
তাহলে এবার আমাদেরকে সচেতন থাকতে হবে, মানুষের আবাসস্থল এর কাছাকাছি যাতে বাদুড়ের আবাসস্থল গড়ে না ওঠে সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। এই সমস্ত ছোটখাটো বিষয়ে আমরা সচেতন হয়ে উঠলেই, অনেক ধরনের বিভিন্ন মহামারী কে আমরা রোধ করতে পারব।
সুস্থ থাকুন, পড়তে থাকুন।