নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে কখনো রক্তে বিপদজনক ভাবে বাড়তে পারে গ্লুকোজের পরিমান: গবেষণা তথ্য
ডঃ শুভময় ব্যানার্জী, পিএইচডি, নিউক্র্যাড হেলথ বাংলার প্রতিবেদন, আগস্ট ২৫, ২০২0
বর্তমান কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিকে যে সমস্ত রোগী নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে চলে যাচ্ছেন প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমটি হলো উচ্চ রক্তচাপ এবং দ্বিতীয়টি হলো ডায়াবেটিস। দ্বিতীয় কারণটি নিয়ে সম্প্রতি বিজ্ঞানীমহলে চিন্তা দেখা দিয়েছে। এতদিন পর্য্যন্ত জানা ছিল যে সমস্ত রোগী বহুদিন থেকেই ডায়াবেটিসে ভুগছেন, নভেল করোনা সংক্রমণ তাদের অসুস্থতায় জটিলতার সৃষ্টি করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। সম্প্রতি গবেষণায় জানা যাচ্ছে, যাদের কোনোদিনই ডায়াবেটিস ছিল না সেই সব মানুষের SARS-CoV-2 সংক্রমণের পর রক্তে দেখা দিচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত গ্লুকোজ যা শরীরে এনে দিচ্ছে প্রচন্ড অসুস্থতা। একে চিকিৎসকরা “স্ট্রেস হাইপারগ্লাইসেমিয়া” বলে উল্লেখ করেন।
স্ট্রেস হাইপারগ্লাইসেমিয়া ও কোভিড-১৯:
কোভিড-১৯ জনিত অসুস্থতার একটি বিশেষ ধাপ হলো শরীরে ‘সাইটোকাইন স্টর্ম’ এর উৎপত্তি। নভেল করোনা সংক্রমণ পরবর্তী সময়ে দেহের অভ্যন্তরে, ইমিউনিটির অতি সক্রিয়তায় বিভিন্ন সাইটোকাইন প্রোটিনগুলির মাত্রা ভীষণ ভাবে বেড়ে যায় এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলি বিকল হতে শুরু করে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, কোভিড-১৯ রোগীর শরীরে তৈরী হয় অস্বাভাবিক ‘স্ট্রেস’ যা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী বিভিন্ন হরমোনের ক্রিয়ার ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে গিয়ে সৃষ্টি হয় স্ট্রেস হাইপারগ্লাইসেমিয়া”।
কিভাবে হাইপারগ্লাইসেমিয়া নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়িয়ে তোলে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন বিজ্ঞানীরা। আমেরিকার একটি গবেষণায় দেখা গেছে মোট ৮৮টি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১১২২ জন করোনা রোগীর মধ্যে শতকরা ২৮. ৮ জনের সঙ্কটজনক অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে যাদের হাইপারগ্লাইসেমিয়ার উপসর্গ ছিল। সেই তুলনায় হাইপারগ্লাইসেমিয়া বিহীন রোগীর মৃত্যুর হার অনেক কম, মাত্র শতকরা ৬. ২ জন। ইটালির সাইন্টিফিক ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ, হস্পিটালাইজেশন অ্যান্ড হেলথকেয়ার মাল্টিমিডিয়ার ডায়াবেটিস বিভাগের চিকিৎসক ডঃ অ্যান্তোনিও সেরিল্লো প্রথমেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কোভিড-১৯ রোগীদের গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন। রক্তে অত্যাধিক গ্লুকোজ থাকলে সঙ্গে সঙ্গে তা উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ‘নর্মালাইজ’ করে অর্থাৎ স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আসতে হবে। এতে রোগীর বিপদের ঝুঁকি অনেকাংশে কম হবে বলে তিনি মনে করেন। এছাড়াও ডঃ সেরিল্লো তাঁর গবেষণায় হাইপারগ্লাইসেমিয়া কিভাবে SARS-CoV-2 কে দেহকোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে সেই ঘটনার আণবিক কৌশল (Molecular Mechanism) আবিষ্কার করেছেন। তাঁর এই গবেষণার কাজ “ডায়াবেটিস রিসার্চ অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল প্র্যাক্টিস” প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
ডঃ সেরিল্লোর মতে, নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমনে শরীরে তৈরী হয় প্রদাহ জনিত বিক্রিয়া (Inflammatory Reaction) যার ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায়। মাত্রাতিরিক্ত গ্লুকোজ ফুসফুসের এপিথেলিয়াল কোষের কোষপর্দায় অবস্থিত অ্যাঞ্জিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম-2 (ACE2) রিসেপ্টর প্রোটিনের “গ্লাইকোসাইলেশন” (প্রোটিনের সাথে কার্বোহাইড্ৰেট অনু যুক্ত হবার জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া) অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে দ্রুত কোষের মধ্যে SARS-CoV-2 প্রবেশ করতে থাকে ও সংক্রমন ছড়ায়।
এই প্রসঙ্গে, ব্রাজিলের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যাম্পিনাসের জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ডঃ পেড্রো এম. মোরেইস-ভিএইরার বক্তব্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি গবেষণা করে দেখেছেন, কোভিড-১৯ রোগীর ফুসফুসের কোষের চারপাশে বেশি পরিমানে জমা হতে থাকে মনোসাইট এবং ম্যাক্রোফেজ। SARS-CoV-2 এর সংক্রমণে এই সব ইমিউন কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া থেকে প্রচুর পরিমানে তৈরী হয় রিঅ্যাক্টিভ অক্সিজেন স্পিসিস বা ROS। তার প্রভাবে কোষের ট্রান্সক্রিপশানে সাহায্যকারী প্রোটিন (Transcription Factor) হাইপোক্সিয়া ইনডিউসিবল ফ্যাক্টর 1-আলফা (HIF-1 alpha) গ্লাইকোলাইটিক জিন গুলির ট্রান্সক্রিপশন বাড়িয়ে দেয়। আরো দেখা গেছে, এই সময়ে শরীরে গ্লুকোজের পরিমান খুব বেশী থাকে, ফলে ইমিউন কোষগুলির গ্লুকোজ বিপাকক্রিয়া ব্যাপকহারে বিঘ্নিত হয়। ডঃ মোরেইস-ভিএইরার গবেষণা প্রমান করেছে এই পরিবর্তিত বিপাকক্রিয়া “সাইটোকাইন স্টর্ম” সৃষ্টির জন্যে দায়ী। এর ফলে টি-লিম্ফোসাইটের কার্যকারিতা অনেকাংশে কমে যায় এবং ফুসফুসের এপিথেয়াল কোষগুলির দ্রুত মৃত্যু ঘটে। বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাকে কোভিড-১৯ নিউমোনিয়ার প্রধান কারণে বলে মনে করেন। সুতরাং, নভেল করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর শরীরে অত্যাধিক গ্লুকোজের পরিমান কমানো এবং সেই সাথে হাইপোক্সিয়া ইনডিউসিবল ফ্যাক্টর 1-আলফা ইনহিবিটরের ব্যবহার কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেই বিষয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা চলছে।
তথ্যসূত্রঃ
- Ceriello A. Hyperglycemia and the worse prognosis of COVID-19. Why a fast blood glucose control should be mandatory. Diabetes Res Clin Pract. 2020;163:108186. doi:10.1016/j.diabres.2020.108186
- Ceriello A, Standl E, Catrinoiu D, et al. Issues for the management of people with diabetes and COVID-19 in ICU. Cardiovasc Diabetol. 2020;19(1):114. Published 2020 Jul 20. doi:10.1186/s12933-020-01089-2
- Ceriello A, Stoian AP, Rizzo M. COVID-19 and diabetes management: What should be considered?. Diabetes Res Clin Pract. 2020;163:108151. doi:10.1016/j.diabres.2020.108151
- Codo AC, Davanzo GG, Monteiro LB, et al. Elevated Glucose Levels Favor SARS-CoV-2 Infection and Monocyte Response through a HIF-1α/Glycolysis-Dependent Axis [published online ahead of print, 2020 Jul 17]. Cell Metab. 2020;S1550-4131(20)30365-X. doi:10.1016/j.cmet.2020.07.007
- Annweiler C, Cao Z, Wu Y, et al. Counter-regulatory ‘Renin-Angiotensin’ System-based Candidate Drugs to Treat COVID-19 Diseases in SARS-CoV-2-infected patients [published online ahead of print, 2020 May 17]. Infect Disord Drug Targets. 2020;10.2174/1871526520666200518073329. doi:10.2174/1871526520666200518073329
- Duette G, Pereyra Gerber P, Rubione J, et al. Induction of HIF-1α by HIV-1 Infection in CD4+ T Cells Promotes Viral Replication and Drives Extracellular Vesicle-Mediated Inflammation. mBio. 2018;9(5):e00757-18. Published 2018 Sep 11. doi:10.1128/mBio.00757-18