নভেল করোনাভাইরাসের মৌলিক গবেষণায় সাহায্য করছে অরগ্যানয়েড কালচার এবং ট্রান্সজেনিক অ্যানিম্যাল মডেল
ডঃ শুভময় ব্যানার্জী, পি.এইচ.ডি নিউক্র্যাড হেলথ বাংলা জুলাই ৩, ২০২০
বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত অতিমারী কোভিড-১৯ এর আগ্রাসনে রাশ টানতে এই মুহূর্তে দরকার করোনা ভ্যাকসিন এবং প্রয়োজনীয় অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ। সেই কাজের পাশাপাশি নভেল করোনা ভাইরাসের চরিত্র, জীবনচক্র, সংক্রমণ প্রবনতা এবং তার শারীর-রোগবিদ্যা (Pathophysiology) যথাযথ ভাবে বুঝতে মৌলিক গবেষণার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এই গবেষণা ছাড়া, কোনভাবেই জীবনদায়ী ওষুধগুলির প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্ভব নয়। গবেষণাগারে, মানুষের বা তার কাছাকাছি স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহের কোষগুলিকে কালচার করে তার উপর ভাইরাস ও ড্রাগের প্রভাব দেখার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হোল-ইন-ভিট্রো (In-Vitro) গবেষণা। আর, স্তন্যপায়ী প্রাণীকে ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত করে, বিভিন্ন ড্রাগের প্রভাব ও ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করা যায় ইন-ভিভো (In-Vivo) গবেষণার সাহায্যে। কিন্তু, SARS-CoV-2 (নভেল করোনাভাইরাস) এর উপর মৌলিক গবেষণা চালানোর মতো উপযুক্ত ইন-ভিভো এবং ইন-ভিট্রো মডেল খুঁজে পাওয়া যথেষ্ট কঠিন কাজ। এর প্রথম কারন হোল, ভাইরাসটি সম্পূর্ণ অচেনা। দ্বিতীয়ত, গবেষণাগারে, কৃত্রিম শারীরবৃত্তিয় পরিবেশে, কোন কোষ কতোটুকু এই করোনা ভাইরাসের দ্বারা সংক্রমণযোগ্য বা আদৌ সংক্রমণযোগ্য কিনা, সেই তথ্য বিজ্ঞানীদের জানা ছিলোনা। পরবর্তী ক্ষেত্রে, টিসু কালচার, অরগ্যানয়েড কালচার এবং বিশেষ অ্যানিম্যাল মডেল ব্যাবহার করে, SARS-CoV-2 এর মৌলিক গবেষণার কাজে অভাবনীয় সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
SARS-CoV-2 এর সংক্রমণ কৌশল (Mode of infection) জানতে ইন-ভিট্রো গবেষণার প্রয়োগ
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, নভেল করোনাভাইরাস কেন প্রধানতঃ ফুসফুস ও শ্বাসনালীর কোষগুলিকে আক্রমন করে? এই প্রশ্নের উত্তর হোল, মানুষের ফুসফুসের কোষে, পাওয়া যায় প্রয়োজনীয় রিসেপ্টর প্রোটিন, অ্যাঞ্জিওটেন্সিন কনভার্টিং উৎসেচক-২ (ACE-2) এবং ট্রান্সমেমব্রেন সেরিন প্রোটিনেজ-২ (TMPRSS-2)। সংক্রমণের সময়, করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন (S-Protein) এর সাথে কোষের রিসেপ্টর প্রোটিন যুক্ত হয় এবং বাকি দুটি উৎসেচকের সাহায্যে ভাইরাসকে কোষের ভিতরে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়।এই পুরো ঘটনাটি, ফুসফুস থেকে প্রাপ্ত প্রাইমারি এয়ার এপিথ্যালিয়াল কোষের (Primay Airway Epithelial Cell) উপর গবেষণা করে জানা যায়। কিন্তু, কিছু সময় পরে এই প্রাইমারি কোষটিকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিলো। কোষটিকে নিয়ে গবেষণা চালানো বেশ ব্যায়বহুল এবং কোষটিকে খুব বেশিদিন কালচার করা যায় না। ফলে, বিজ্ঞানীরা অন্যান্য কোষ নিয়ে (যে কোষগুলি অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়) গবেষণা শুরু করলেন। কিন্তু, এইবারে দেখা গেলো, নভেল করোনাভাইরাস ওই কোষগুলিকে অত্যন্ত কম পরিমানে সংক্রমিত করে। এই কাজে সাফল্য পেলেন, বিজ্ঞানী জেনিফার হারকোর্ট। তিনি ‘ভেরো’ কোষ (আফ্রিকান গ্রীন বানরের কিডনির থেকে পাওয়া কোষ) ব্যাবহার করলেন। মজার ব্যাপার হোল, এই কোষটিতে অ্যান্টিভাইরাল প্রোটিন-‘ইন্টারফেরন’ তৈরি হয় না। ফলে, নভেল করোনাভাইরাস অনায়াসে কোষে প্রবেশ করে প্রতিলিপিকরন (Replication) ঘটাতে পারে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, টোকিওর ন্যাশনাল ইন্সিটিউট অফ ইনফেক্সিয়াস ডিজিজ (National Institute of Infectious Disease) এর বিজ্ঞানী, ডঃ সুতোকু মাৎসুয়ামা জেনেটিক্যালি এঞ্জিনিইয়ার্ড (Genetically Engineered) ভেরো-E6 কোষে, TMPRSS-2 প্রোটিনটি বেশীমাত্রায় প্রবেশ করিয়ে SARS-CoV-2 সংক্রমণ বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমান গবেষণায়, ইন-ভিট্রো টিসু কালচার ব্যাবস্থায় কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, যেমন- নির্দিষ্ট কোষ নিয়ে, বিশেষ শর্তসাপেক্ষে (With Special Conditions) কালচার করে, ভাইরাস সংক্রমণ ঘটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা আর প্রকৃতপক্ষে, মানুষের শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের সংক্রমণ পর্যবেক্ষণ করার মধ্যে অনেক তফাৎ থেকে যায়। তাই, বিজ্ঞানীরা শুরু করলেন অরগ্যানয়েড কালচারকে কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে।
ত্রিমাত্রিক (3D) অরগ্যানয়েড কালচার: ইন-ভিট্রো গবেষণার এক অভাবনীয় ধারা
আধুনিক ইন-ভিট্রো মডেল হিসাবে বিজ্ঞানীমহলে সমাদৃত হয়েছে ত্রিমাত্রিক অর্গ্যানয়েড কালচার (3-Dimensional Organoid Culture)। তবে, এই প্রসঙ্গে আলোচনার আগে বুঝে নেওয়া যাক- ‘অর্গ্যানয়েড’ আসলে কি? মাউসের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের অতি ক্ষুদ্র সংস্করণ হলো এই ‘অর্গ্যানয়েড’। একে সহজেই টিসু কালচারের মতো কৃত্রিম শারীরবৃত্তীয় পরিবেশে বর্ধিত ও রক্ষনাবেক্ষন করা যায়। কিভাবে করা হয় এই অর্গ্যানয়েড কালচার? বিজ্ঞানীরা মানুষের শরীর থেকে বায়োপসি করে সংগ্রহ করেন বিভিন্ন অঙ্গের কলাকোষ। নির্দিষ্ট অঙ্গ থেকে নেওয়া কোষগুলিকে বিশেষ মাধ্যমে (Special Media) ও শর্তসাপেক্ষে (Conditions) কালচার করা হয়। কোষগুলি ক্রমাগত বিভাজিত হয়ে ক্ষুদ্র অঙ্গের আকৃতি গঠন করে। এই ক্ষুদ্র অঙ্গটি (Mini Organ) শরীরের মূল অঙ্গের সমস্ত বৈশিষ্ট বহন করে। একেই বলে অর্গ্যানয়েড। গবেষণাগারে অন্ত্র, পাকস্থলী, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, ফুসফুস এমনকি মস্তিষ্কেরও অর্গ্যানয়েড কালচার করা সম্ভব হয়েছে।
সম্প্রতি, গবেষণায় দেখা গেছে, অর্গ্যানয়েডের উপর SARS-CoV-2 এর সংক্রমণ ঘটিয়ে ভাইরাসের প্যাথোফিজিওলোজি পুঙ্খনাপুঙ্খ অনুধাবন করা যায়। এমনকি, প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হিসাবে অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগের পরীক্ষা, এই অর্গ্যানয়েড কালচারের মাধ্যমে করা সম্ভব। কিন্তু, এক্ষেত্রেও কিছু জটিলতা দেখা দিলো। বস্তুতঃ অর্গ্যানয়েডগুলি দেহের বিচ্ছিন্ন অঙ্গ হিসাবে কাজ করে। বাস্তবে, করোনা সংক্রমণ শ্বাসনালী, ফুসফুস থেকে রক্ত সংবহনের মাধ্যমে সাড়া শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রদাহজনিত বিক্রিয়া (Inflammatory Reaction)। অর্থাৎ শুধুমাত্র অর্গ্যানয়েড কালচারের মাধ্যমে সাড়া শরীরের ‘সিস্টেমিক রেসপন্স’ পর্যালোচনা করা সম্ভব নয়। ফলে বিজ্ঞানীদের চিন্তা ভাবনা শুরু হলো নভেল করোনাভাইরাসের ইন-ভিভো বা ‘অ্যানিম্যাল মডেল’ নিয়ে।
নভেল করোনাভাইরাস গবেষণায় ‘অ্যানিম্যাল মডেল’ এর প্রয়োগ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এবং সংক্রমণের পরে বিভিন্ন অঙ্গের প্যাথোফিজিওলোজি জানার ধাপগুলি এতটাই জটিল যে, সে সম্পর্কে সম্যক ধারনা পেতে পোষক (Host) ও ভাইরাসের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক (Inter-relationship) বোঝা সবার আগে প্রয়োজন। ঠিক সেই কারনেই, বিজ্ঞানীরা অ্যানিম্যাল মডেলের উপর নির্ভর করেন। তবে, এই ক্ষেত্রেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। সাধারন ভাবে, স্তন্যপায়ী প্রানীদের মধ্যে ইঁদুর বা ‘মাউস মডেল’ বিজ্ঞানীদের পছন্দ। অথচ, গবেষণায় দেখা গেলো, SARS-CoV-2 মোটেও ইঁদুরকে সংক্রমণ করে না! ফলে, উপায় কি? বেজিং এর কি ল্যাবোরেটরি অফ হিউম্যান ডিজিজ কম্প্যারেটিভ মেডিসিন (Key Laboratory of Human Disease Comparative Medicine) বিভাগের বিজ্ঞানী লিনলিন বাও এক চমকপ্রদ তথ্য আবিষ্কার করলেন। তিনি দেখলেন, ইঁদুরের দেহের কোষে ACE-2 প্রোটিনটি থাকে না, যা করোনাভাইরাসের পোষক কোষে প্রবেশের জন্যে অত্যন্ত জরুরী। সেক্ষেত্রে, ডঃ বাও, মানুষের ACE-2 প্রোটিন ইঁদুরের কোষে প্রবেশ করিয়ে ট্রান্সজেনিক ইঁদুর (Transgenic Mice) তৈরি করলেন। দেখা গেলো, ওই ট্রান্সজেনিক ইঁদুর সহজেই করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হোল এবং মানুষের মতোই তার শরীরে করোনা রোগের উপসর্গ প্রকাশ পেল! বর্তমানে, ট্রান্সজেনিক ইঁদুরের সাথে একই বিষয়ে সিরিয়ান হ্যামস্টারের উপরেও গবেষণা চলছে। কিছুদিন আগেই শুরু হয়েছে প্রাইমেট সায়ানোমলগাস বানর (Primate Cynomolgus Macques) আর রেসাস বানর (Rhesus Monkey) নিয়ে ইন-ভিভো গবেষণার কাজ। শ্রেণীবিন্যাস বিজ্ঞান (Taxonomy) অনুযায়ী, মানুষের খুব কাছাকাছি প্রাণী হওয়ায়, করোনা ভ্যাকসিনের প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রেসাস বানরকে ব্যাবহার করা হচ্ছে। আশার কথা, ইতিমধ্যেই অ্যাডেনোভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন, ডিএনএ ভ্যাকসিন এবং অ্যান্টিভাইরাল রেমডিসিভির ড্রাগ রেসাস বানরের উপর প্রয়োগ করে ভালো ফল পাওয়া গেছে।
প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে, করোনার ড্রাগ আবিষ্কারের সাথে মৌলিক গবেষণার কাজ অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে আছে। তবেই বিজ্ঞানীদের পক্ষে নভেল করোনাভাইরাসের জৈব-সংক্রমণবিদ্যা (Infection Biology) সঠিক ভাবে বোঝা সক্ষম হবে। সারা বিশ্বের গবেষক ও বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টা সেই কাজের পথকে দিনে দিনে সুগম করছে।
তথ্যসূত্রঃ
- Takayama, Kazuo. “In Vitro and Animal Models for SARS-CoV-2 research.” Trends in pharmacological sciences, S0165-6147(20)30129-2. 30 May. 2020, doi:10.1016/j.tips.2020.05.005
- Zhou P, Yang XL, Wang XG, et al. A pneumonia outbreak associated with a new coronavirus of probable bat origin. Nature. 2020;579(7798):270-273. doi:10.1038/s41586-020-2012-7
- Matsuyama S, Nao N, Shirato K, et al. Enhanced isolation of SARS-CoV-2 by TMPRSS2-expressing cells. Proc Natl Acad Sci U S A. 2020;117(13):7001-7003. doi:10.1073/pnas.2002589117
- Ranga A, Gjorevski N, Lutolf MP. Drug discovery through stem cell-based organoid models. Adv Drug Deliv Rev. 2014;69-70:19-28. doi:10.1016/j.addr.2014.02.006
- Bao L, Deng W, Huang B, et al. The pathogenicity of SARS-CoV-2 in hACE2 transgenic mice [published online ahead of print, 2020 May 7]. Nature. 2020;10.1038/s41586-020-2312-y. doi:10.1038/s41586-020-2312-y