ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড বাংলা, উড়িষ্যা; বহু এলাকা জুড়ে পানীয় জলের হাহাকার, এরই মধ্যে থাবা বসাতে পারে প্রানঘাতী জলবাহিত রোগ
20ই মে উড়িষ্যা এবং পশ্চিমবঙ্গের উপর আছড়ে পড়েছিল সুপার সাইক্লোনিক ঝড়, আম্ফান। গত 13 ই মে শ্রীলঙ্কার থেকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে সাধারণ নিম্নচাপ হিসাবে জন্ম নেয় আম্ফান, কিন্তু 17ই May নাগাদ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এবং 20ই মে সুপার সাইক্লোন হিসেবে আঘাত হানে উড়িষ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলে। আম্ফানের গতিবেগ ছিল প্রায় 155 কিমি / ঘন্টা। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনারকে ব্যাপকভাবে আঘাত হেনেছে। কয়েক হাজার হেক্টর ধানের ক্ষেত এবং সবজি খামার জলে ডুবে গেছে, অগুন্তি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে; কলকাতা এবং পার্শ্ববর্তী জেলাগুলিতে কয়েক দিনের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ এবং নেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আম্ফানের ফলে।
এই পরিস্থিতিতে, জলবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি খুব বেশি। ঝড়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলির মানুষগুলির বর্তমান স্বাস্থ্যবস্থা কীরূপ ও ঐ এলাকাগুলিতে জলবাহিত রোগের প্রকোপ কেমন আকার ধারণ করতে পারে? আসুন আমরা জেনে নিই।
ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলে পরিস্থিতি কী?
আম্ফানের প্রভাবের কারণে কলকাতা এবং আশেপাশের অঞ্চলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে 200 মিমির বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর ফলে বহু জায়গা জলে ডুবে রয়েছে, দেখা যাচ্ছে পানীয় জলের সঙ্কট। অনেক অঞ্চলেই বেশিরভাগ নলকূপ জলে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎ পরিসেবা ব্যাহত থাকায় এবং জলের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়, পাওয়া যায়নি পৌরসভার জল। জলবন্টন কেন্দ্রগুলি থেকে একটু পানীয়জল সংগ্রহের জন্য কাতারে কাতারে মানুষ লাইন দিচ্ছে। তবে, স্যানিটাইজেশন পদ্ধতি বেশ দুর্বল, যার কারণে জলবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবের ব্যাপক ঝুঁকি রয়েছে। এমতাবস্থায় খাবার আগে পানীয় জল ভালোকরে ফুটিয়ে নিয়ে তবেই ব্যবহার করতে হবে, যাতে তারা কলেরা, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, অ্যামিবিয়াসিস এবং হেপাটাইটিস-এ হাত থেকে রক্ষা পায়। এইসব জলবাহিত রোগগুলোর সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে নিবন্ধটি পড়তে থাকুন।
ঘূর্ণিঝড়ের পরে ছড়াতে পারে এমন কয়েকটি জলবাহিত রোগের তালিকা:-
কলেরা:–
কলেরা হ’ল এমন একটি জলবাহিত রোগ, যা দ্রুত সংক্রামিত হয়। ভিব্রিও কলেরি নামক ব্যাকটিরিয়া উপস্থিত এমন পানীয় জল বা খাবার খাওয়ার ফলে কলেরা সৃষ্টি হয়।
কলেরায় আক্রান্ত ব্যাক্তির ডায়রিয়া, বমি, বমি ভাব, ডিহাইড্রেশন, দ্রুত হার্টবিট, ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস এবং মিউকাস ঝিল্লির শুষ্ক হয়ে পড়া ইত্যাদি নানান উপসর্গ দেখা যায়। যদি কলেরা আক্রান্ত রোগীর তৎক্ষণাৎ সঠিক চিকিৎসা না হয় তহলে তীব্র ডিহাইড্রেশন এবং ইলেক্ট্রোলাইটিক ভারসাম্যহীনতা দেখা যেতে পারে।
কলেরায় আক্রান্ত রোগীর শরীর থেকে যেহেতু প্রচুর পরিমাণ জল বেরিয়ে যায, তাই চিকিৎসকরা ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন (ORS) খাবার পরামর্শ দেন। খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে চিকিৎসকরা ইনজেকশন এবং অ্যান্টিবায়োটি দিয়ে থাকেন।
এই রোগ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য খাওয়ার আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে, পানীয় জল প্রথমে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে তারপর খেতে হবে। যেকোনো শাকসব্জিই বা ফলমূল খাবার আগে বা রান্নার আগে গরম জলে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
টাইফয়েড:-
টাইফয়েড হল আরেকটি জলবাহিত সংক্রামক রোগ যা সালমোনেল্লা টাইফিমিউরিয়াম (S. typhi) ব্যাকটিরিয়াম দ্বারা সৃষ্ট। দূষিত খাবার, পানীয় জল বা দুর্বল স্যানিটেশনের মাধ্যমে লোকেরা টাইফয়েডে আক্রান্ত হতে পারে। শারীরিক দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, পেট ফাঁপা, ক্ষুধা-মন্দা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য এবং শুকনো কাশিসহ নানাবিধ উপসর্গগুলিরই পাশাপাশি ,104 ডিগ্রি ফারেনহাইট অবধি জ্বর দেখা যায়। চিকিৎকরা সিপ্রোফ্লোক্সাকিন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন এবং সেফ্ট্রিয়াক্সনের ইত্যাদি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে চিকিৎসা করেন। যদিও দু’বছরের বেশি বয়সী লোকের জন্য টাইফয়েডের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনও রয়েছে। এই ভ্যাকসিনের টাইফয়েডে রোগের ঝুঁকি বহুগুণ হ্রাস করে।
হেপাটাইটিস A :-
এটি হল হেপাটাইটিস-A ভাইরাস (HAV) দ্বারা সৃষ্ট লিভারের একটি সংক্রমণ।
এটি অত্যন্ত সংক্রামক। হেপাটাইটিস-A দ্বারা কনটামিনেটেড জল পান করার মাধ্যমে এটি সংক্রামিত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির খাওয়া খাবার গ্রহণ করলে এবং হেপাটাইটিস এ পজিটিভ ব্যক্তিদের সাথে খুব ঘনিষ্ঠতার ফলেও ছড়িয়ে পড়ে এই রোগ। রোগীদের হাল্কা জ্বর, পেটে ব্যথা, বমি অথবা বমি বমি ভাব, কাদার মতো মলত্যাগ ইত্যাদি নানান উপসর্গ দেখা দেয়। পাশাপাশি গাড় হলুদ প্রস্রাব, চোখ এবং ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া, ও তীব্র চুলকানির দেখা যায়। চিকিৎসকরা হেপাটাইটিস-A সংক্রমণের নির্ণয়ের জন্য রক্ত পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন। তবে অন্যান্য লিভারের সংক্রমণের মতো নয়, এটি দীর্ঘমেয়াদী ভাবে লিভারের কোনো ক্ষতিকরে না এবং যথাযথ যত্ননিলে এটি নিজেই নিরাময় হয়ে যায়।
এই রোগের প্রকোপ রোধ করার জন্য একটি হেপাটাইটিস-A ভ্যাকসিনও রয়েছে।
সুতরাং, এইসব জলবাহিত রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে, ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার লোকদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এই রোগগুলির সম্ভাবনা যথাসাধ্য কম করতে সঠিক হাইজিন মেনে চলুন এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস গড়ে তুলুন।