গর্ভাবস্থার প্রথম তিনমাস – ভ্রূণের বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়
নিউক্র্যাড হেলথ বাংলার একটি নিজস্ব প্রতিবেদন, কলমে শুভ্রা, অনুবাদ ও অক্ষরদানে-মোনালিসা মার্চ 26, 2019
অভিনন্দন! তুমি গর্ভবতী। যে মুহূর্তে মহিলারা তাদের স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে এই চমৎকার খবরটি পান, তখন থেকেই তাদের জীবনে একটি সম্পূর্ণ নতুন সময়ের পালা শুরু হয়।
মাতৃত্ব হলো জীবনের বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতা গুলির সর্বশ্রেষ্ঠ। কি অদ্ভুত এক আশ্চর্য উপায়ে মাতৃজঠরে একটি কোষ বিভাজিত হয়ে একটি সম্পূর্ণ নতুন সত্তার জন্ম দেয়! ঠিক যেন এক জাদুর খেলা, তাই না? ভালবাসার মানুষদের সাথে এই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে নিতেই , কখন যে গর্ভধারণের 40 সপ্তাহ পার হয়ে যায় আমরা বুঝতেই পারিনা।
যাই হোক এটা মনে রাখা উচিত, যে গর্ভাবস্থা কিন্তু একটি মায়ের জন্য খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। এই সময় কিন্তু একটি মাকে বিভিন্ন রকম মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এবং গর্ভাবস্থায় প্রতি তিন মাসের মধ্যে মানসিক অবস্থা এবং শারীরিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। তাই গর্ভাবতী মায়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি ত্রৈমাসিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক কি?
গর্ভাবস্থার প্রথম ত্রৈমাসিক শেষ মাসিক চক্র বন্ধের দিন থেকে (এলএমপি) শুরু হয়ে, গর্ভাবস্থার 1২ সপ্তাহের শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে। মায়ের পাশাপাশি ভ্রূণের বিকাশের ক্ষেত্রে এটি একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। একজন মা গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায়, যেমন সেই সময় তার মাসিক চক্র বন্ধ থাকে, ক্লান্তি এবং অবসন্নতা দেখা যায়। এছাড়াও এই সময় খুব তাড়াতাড়ি মেজাজ পরিবর্তন, বিভিন্ন হরমোনাল পরিবর্তন, ঘনঘন প্রসাব, অম্বল বা বমি ভাব এই সমস্ত বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
গর্ভাবস্থার এই প্রথম সময়েহয় কি, ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নিঃসৃত হয়ে, ডিম্বনালীর মাধ্যমে গর্ভাশয়ে এসে পৌঁছায় এবং সেখানে শুক্রাণুর সাথে মিলিত হয়ে জাইগোট গঠন করে। এবং একটি কোষ থেকে ক্রশশ বিভাজিত হয়ে একটি পিন্ড বা ব্লাস্টুলা গঠন করে। এবং এই জায়গা থেকে যে ভ্রূণের সৃষ্টি হয় সেটি জরায়ু অন্তগাত্রে প্রোথিত হয়ে যায়। তারপর ধীরে ধীরে এই সময় শিশুর মস্তিষ্ক এবং সুষুম্নাকাণ্ড গঠন হতে থাকে, এই তিন মাসের মধ্যেই একটি ভ্রূণের হৃদস্পন্দনও অনুভব করা যায়।
মাতৃত্বের প্রথম তিন মাসে একজন মহিলা কি কি লক্ষণ বা উপসর্গের সম্মুখীন হন?
এই সময় একটি মায়ের দেহে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। তার মধ্যে কয়েকটি নিয়ে আলোচনা করা হল:-
মাসিক স্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া:-
মাতৃত্বের প্রথম লক্ষনই হলো মাসিক স্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া। যখন একটি ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর সাথে মিলিত হয় অর্থাৎ যখনি নিষেক পক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যায়, নারী দেহে প্রজেস্টেরন হরমোনের ক্ষরণ খুব বেশি পরিমাণে হতে থাকে। প্রচুর পরিমাণে ক্ষরিত প্রজেস্টেরন আসলে জরায়ুর অন্তর্গঠন কে ঠিক রাখতে সাহায্য করে এবং মাসিক চক্র বন্ধ বন্ধ রেখে জরায়ুর গঠন গর্ভধারণের জন্য উপযুক্ত করে তোলে।
বমি বা বমি বমি ভাব:-
মাতৃত্বকালীন অবস্থায় একজন মহিলা সব থেকে বেশি যে সমস্যার সম্মুখীন হয় তা হল সকালবেলায় অত্যন্ত দুর্বল ও তার সম্মুখীন হতে হয় অনেক সময় দেখা যায় বা বমি না হলেও বমি বমি ভাব প্রায় বেশিরভাগ মহিলার ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়। আসলে এই সময় ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন, এবং কোলেসাইটোকাইনিন বা হিউম্যান ক্রনিক গোনাডোট্রপিন হরমোন গুলি প্রচুর পরিমাণে ক্ষরিত হতে থাকে, আর এই হরমোন গুলির অতিরিক্ত ক্ষরনই বমি বমি ভাব বা শারীরিক দুর্বলতার মূল কারণ। এছাড়াও রক্তে শর্করার পরিমাণ হ্রাস পায় তার ফলেও অনেক সময় সকাল বেলায় শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রচুর পরিমাণে জলপান এবং আদা জাতীয় খাবার খেলে অনেক সময় এই সমস্যার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
ঘন ঘন প্রস্রাব:-
মাতৃত্বকালীন অবস্থায় খুব ঘনঘন প্রসাবে পেতে থাকে এর পিছনে মূল কারণ হচ্ছে এই সময় দেহে রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, ফলে কিডনিতে রক্ত পরিশ্রুতকরনের প্রক্রিয়াটিও বৃদ্ধি পায়। আরি রক্ত পরিশ্রুত করনের প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব জমা হয়।
এসিডিটি এবং বুক জ্বালা:-
গর্ভকালীন অবস্থায় যে সমস্ত হরমোন গুলি বেশি মাত্রায় ক্ষরিত হয়, সেই সমস্ত হরমোন গুলি অনেক সময় খাদ্যনালী এবং পাকস্থলীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ইসোফেগাল স্পিন্কার ভাল্বকে খুলে দেয়। এর ফলে পাকস্থলির থেকে ক্ষরিত রস খাদ্যনালী উপরের দিকে উঠে আসে এবং যার ফলে গলায় জ্বালা বুকে জালা ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ধরনের অনুভুতি গুলো দেখা যায়। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞগণ জানিয়েছেন, কম কম করে নির্দিষ্ট সময় অন্তর খাওয়া এবং ভাজাভাজি বা মশালাদার খাবার যদি এই সময় খাওয়া না হয় তাহলে এই ধরনের সমস্যা গুলি থেকে সহজেই কম করা যায।
গর্ভাবস্থায় একজন মায়ের কি কি ধরনের খাবার খাওয়া উচিৎ?
যেতে সময় সকালের দিকে শরীর অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে শ্রী রবি শংকর জানিয়েছেন এই সময় কিন্তু খাবার-দাবারের দিকে খেয়াল রাখাটা প্রয়োজন। আসলে মাতৃত্বকালীন যে সমস্ত হরমোন খরিত হয় সেগুলির বেশি মাত্রার সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য দেহের বেশ কিছুটা সময় লাগে তাই এই সময় কম কম পরিমাণে কিন্তু সঠিক ঠিক সময়ে সময়ে খাওয়া দাওয়া করলে বমি বুকজ্বলার মত সমস্যা গুলি থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া সম্ভব আবার বিভিন্ন ধরনের দুগ্ধজাত পদার্থ (যেমন দুধ, দই, ইয়োগার্ট, পনির, চিজ) বা শিম্বী গোত্রীয় বিভিন্ন সবজি (যেমন ছোলা, মটর শুটি, সয়াবিন, বিনস্), ডিম, শাকসবজি, মাংস এই ধরনের খাবার মাতৃত্বকালীন সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও অনেক সময় চিকিৎসকেরা মা ও শিশুর সঠিক বৃদ্ধির জন্য ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন এই সমস্ত সাপ্লিমেন্টরি খেতেও পরামর্শ দেন।
মাতৃত্বকালীন সময় কি ব্যায়াম করা উচিৎ?
মাতৃত্বকালীন সময়ে হালকা ব্যায়াম বা যোগা খুবই ভালো কারণ যোগা এনার্জি লেভেল ও বডি ব্যালেন্স বাড়াতে সাহায্য করে। যোগা গর্ববস্তায় যে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা শারীরিক সমস্যা দেখা যায় সেগুলো রোধ করতে সাহায্য করে মাতৃত্বকালীন অবস্থায় যে সমস্ত সব থেকেউপযুক্ত হচ্ছে হালকা হাটা, প্রাণায়াম করা ইত্যাদি।
আমরা গর্ভাবস্থায় যে সমস্ত সমস্যা দেখা যায় বা যে সমস্ত বৈশিষ্ট গুলো দেখা যায় তার একটা ব্যাখ্যা ছোটখাটো ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। যাইহোক, মাতৃত্বকালীন অবস্থায় শিশুর সঠিক গঠন ও বৃদ্ধির জন্য এবং মায়ের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য সব থেকে যেটা জরুরী ব্যাপার সেটা হল মানসিক উদ্বেগ কম করে আনন্দ হাসি খুশিতে সময় কাটানো।