নভেম্বর 23, 2024

কোলেস্টেরল- এটি আমাদের বন্ধু নাকি শত্রু?

Reading Time: 3 minutes

নিউক্র্যাড হেলথ বাংলার নিজস্ব প্রতিবেদন

সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুষ্টি সম্পর্কিত উপদেষ্টা প্রদানকারী পরিষদের প্যানেলর তরফে কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার বিষয়ে যে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তা এবার তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।

বিগত চল্লিশ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্য আধিকারিকরা কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ ফ্যাটযুক্ত খাবার গ্রহণের ব্যাপারে জনসাধারণকে সতর্ক করে আসছিলেন। বর্তমানে, শীর্ষস্থানীয় পুষ্টি উপদেষ্টা প্যানেল আবিষ্কার করেছে যে কোলেস্টেরল আমেরিকাতে আর কোনও “উদ্বেগের” কারন নয়।

এই বিষয়ের উপর সর্বশেষ গবেষণাটির ফলাফল অনুযায়ী, কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া মানেই যে হৃদযন্ত্রের সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যাবে, এমনটা কিন্তু নয়। ডিম,কুচো- চিংড়ি বা গলদা চিংড়ি জাতীয় কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার মানব স্বাস্থ্যের জন্য একদমই ক্ষতিকারক নয়। বরং, মাখন এবং ঘি জাতীয় স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবারের অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া, হৃদযন্ত্রের জন‍্য হানিকারক।

আজ আমাদের আলোচনার বিষয় হলো বিভিন্ন প্রকার কোলেস্টেরল এবং মানব স্বাস্থ্যের উপর তার প্রভাব।

কোলেস্টেরল জিনিসটা আসলে কী?
কোলেস্টেরল হল একপ্রকার প্রাকৃতিক ফ্যাট জাতীয় যৌগ, সমস্ত মানব কোষে উপস্থিত রয়েছে। কোলেস্টেরল আমাদের দেহে বিভিন্ন প্রকার হরমোন এবং ভিটামিন-ডি তৈরী করতে সহায়তা করে; সাথে সাথেই খাদ্যের বস্তু পরিপাকেও সহায়তা করে।
কোলেস্টেরলের উপস্থিতি প্রয়োজনীয় হলেও, দেহে এর ঘনত্ব বেড়ে গেলেই শুরু হয় সমস্যার।
এই যৌগগুলির মূল সমস্যা হল একত্রিত হয়ে থাকার প্রবনতা বেশি, একে অপরের প্রতি আকর্ষন -টানও বেশি। এই কারণেই রক্তে কোলেস্টেরলের উচ্চমাত্রার উপস্থিতি দেহে বিভিন্ন সমস‍্যার সৃষ্টি করে।
একসাথে জুড়ে জুড়ে অবস্থানেকারনে ধমনীগুলি ব্লক হয়ে যেতে পারে, এই অবস্থা এথেরোস্ক্লেরোসিস নামে পরিচিত। যা পরবর্তীতে করোনারি আর্টারির মতো প্রাণঘাতী সমস্যারো কারণ হতে পারে।

মানুষের দেহে উপস্থিত কলেস্টেরল এর প্রকারভেদ :-
মানুষের দেহে সাধারণত তিন ধরনের কলেস্টেরল দেখা যায়। এগুলো নীচে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হলো :-

(১) লো-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন (LDL) :-

মানব দেহে উপস্থিত তিন ধরনের কোলেস্টেরল এর মধ্যে সব থেকে ক্ষতিকারক হলো এই লো-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন। এই ধরনের কোলেস্টেরলের একে অপরের সাথে জুড়ে থাকার প্রবণতা সব থেকে বেশি। ফলে কি হয়, এরা রক্ত সংবহননালীর অন্তগাত্রে জমতে শুরু করে। ফলস্বরূপ ধমনীর পুরু ও সংকীর্ণ হয়ে পড়ে, এমতাবস্থায় রক্ত প্রবাহ বাধা প্রাপ্ত হয়, ফলে অনেক সময় হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ব্লকেজ, স্ট্রোক জাতীয় প্রাণঘাতী সমস্যা দেখা দেয়।

এই জন্য হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা কিন্তু সবসময় লো-ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন আছে এইজাতীয় খাদ্য এড়িয়ে যেতে বলেন। যেমন ডিমের কুসুম, তেলেভাজা বিভিন্ন ধরনের খাবার, রেডমিট জাতীয় খাবার। আবার ট্রান্সফ্যাট যুক্ত বেকড ফুড বা অনেক ক্ষেত্রেই যেমন বানানো খাবার বা ভেজিটেবল অয়েল এগুলোও কিন্তু লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন এর পরিমান মানবদেহে বাড়িয়ে দেয়।

(২) হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন (HDL) :-
পুষ্টিবিদ এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দের মতে হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনের আরেক নাম হল “ভালো কোলেস্টেরল”। এই ধরনের কোলেস্টেরল মানবদেহে কোন ক্ষতি তো করেই না বরং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। হাই-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন এর প্রধান কাজ হল এরা মানবদেহে উপস্থিত থেকে খারাপ কলেস্টেরল গুলির একে অপরের সাথে বাইন্ড করে যাওয়ার যে প্রবণতা সেটি বন্ধ করে দেয়।
এর ফলে হার্টের ব্লকেজ বা রক্তনালীর ব্লকেজ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই হ্রাস পায়।
হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন, অতিরিক্ত কোলেস্টেরলকে রক্তবাহ থেকে লিভারে ট্রান্সফার করে; লিভার আবার সেটাকে মেটাবলিক‍্যালি ব্রেকডাউন করে দেহ থেকে বাইরে বার করে দেয়।

বিশেষজ্ঞদের মতানুযায়ী যদি মানবদেহে হাইডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত কমে যায় তাহলেই স্ট্রোক, হৃদযন্ত্রের সমস্যা থেকে মৃত্যু এই ধরনের বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম, ধূমপান না করার অভ্যাস দেহে হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন এর এর পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে।

(৩) ট্রাইগ্লিসেরাইডস:-

ট্রাইগ্লিসারাইড হ’ল মানবদেহে উপস্থিত এক ধরনের ফ্যাট বা স্নেহ পদার্থ। মাখন এবং তেলের মতো চর্বিযুক্ত খাবারগুলিতে ট্রাইগ্লিসারাইড-এর মাত্রা খুব বেশি। দেহ অন্যান্য খাদ্য উৎস, যেমন কার্বোহাইড্রেট থেকেও কিন্তু ট্রাইগ্লিসারাইড তৈরি হয়। যদি ট্রাইগ্লিসারাইড স্তর নিদিষ্টমান মানের মধ্যে থাকে তবে এটি দেহে শক্তি সরবরাহ করতে। তবে দেহে ট্রাইগ্লিসারাইডের অতিরিক্ত উপস্থিতি, হৃদরোগ কারন হতে পারে।

কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা কত?
বায়োকেমিস্টরা প্রতি ডেসিলিটার(dL), অর্থাৎ ১০০ মিলিলিটার রক্তে কত মিলিগ্রাম (mg) কোলেস্টেরল উপস্থিত আছে পরিমাপ করেন। রক্তে মোট কোলেস্টেরল স্তর মানে কিন্তু লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন এবং হাই-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনের মোট পরিমান। কোলেস্টেরলের স্বাভাবিক মাত্রা হল ২০০ mg/ml এর নীচে। এর মধ্যে লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন এর ১৬০ mg/ml এর নীচে এবং হাই-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিনের মাত্রা ৩৫ mg/ml এর উপরে হওয়া উচিত।

আজকের নিবন্ধটি এইটুকুই। আপনি তাহলে কোন কোলেস্টেরল ক্ষতিকর, কোনটি ভালো জেনে গেলেন। সেইমতো খাদ্য নির্বাচন করুন, সাথে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে থাকুন। সুস্থ থাকুন, পড়তে থাকুন।