নভেম্বর 23, 2024

করোনা পরীক্ষা: পিসিআর নাকি র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট, কোনটা উপযুক্ত?

Reading Time: 4 minutes

ড: দীপঙ্কর মান্না, গবেষক বিজ্ঞানী, ইউনিভার্সিটি অফ অসলো, নরওয়ে, জুলাই ৭, ২০২১

করোনা মহামারির দ্বিতীয় তরঙ্গের আকস্মিক প্রকোপ শুধুমাত্র ভারতবর্ষই নয়, গোটা বিশ্বকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে কাটছে আমাদের জীবন। করোনা ভ্যাকসিন বাজারে উপলব্ধ হলেও, পর্যাপ্ত জোগান এবং সুনির্দিষ্ট বণ্টনের অভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগের গতি অনেকটাই কমেছে। যে মাত্রায় ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে তাতে আগামী সংক্রমণের রাশ টানা বেশ শক্ত হতে পারে। সাথে বেড়ে চলেছে ডেল্টা এবং ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্টের দাপট। তাই করোনার তৃতীয় তরঙ্গের সম্ভাবনা কোনভাবেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। স্বাস্থ্যদপ্তর, চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীরা মাস্কের ব্যাবহার, ঘন ঘন হাত ধোয়া এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বারে বারে মনে করিয়ে দিচ্ছেন। তাই আতঙ্ক নয়, সতর্ক হওয়া খুব জরুরি।

করোনা সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি মাপার জন্য করোনা পরীক্ষা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষার মধ্যমেই ভাইরাসের উপস্থিতি এবং বিস্তার সম্পর্কে ধারনা করা যায়, এবং সেই মতো ভাইরাস মোকাবিলার রূপরেখা তৈরি করা হয়। যত বেশী সংখ্যায় করোনা পরীক্ষা হবে, তত বেশী করে জানা যাবে সংক্রমণের গতিবিধি। করোনা পরীক্ষা তিন রকমের হয়- রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (আরটি-পিসিআর), র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট (আরএটি) এবং অ্যান্টিবডি টেস্ট। এই তিনটি টেস্টের মধ্যে প্রথম দুটি টেস্ট নিয়মিত ভাবে করা হয় অ্যাকটিভ ইনফেকশানের উপস্থিতি জানার জন্য, কিন্তু অ্যান্টিবডি টেস্ট বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া করার দরকার হয় না।

আরটিপিসিআর (RT-PCR) টেস্ট:

পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) পরীক্ষা ভাইরাসের জিনোমের একটি ছোট অংশকে প্রশস্ত করে জিনগত উপাদানের উপস্থিতি সনাক্ত করে। এই প্রশস্তকরণ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে সংগৃহীত নমুনায় খুব কম মাত্রার উপস্থিত ভাইরাসের জিনের উপাদান সনাক্ত করা যায়। পিসিআর পরীক্ষা অত্যন্ত সংবেদনশীল। পিসিআর পরীক্ষায় উপসর্গহীন মানুষের দেহে করোনা সংক্রমণের উপস্তিতিও নির্ধারণ করা যায়। এই পরীক্ষায় সংক্রমণের সমস্থ পর্যায়গুলিকেই সনাক্ত করা যায়, এমনকি সক্রমনের কিছু পরে মানবদেহে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতিও জানতে পারা যায়। পিসিআর পরীক্ষা সংক্রমণের পর্যায়গুলির মধ্যে পৃথকীকরণ করতে পারে না। তবে জিন প্রশস্তকরণের পরিমাপের ভিত্তিতে সংক্রমণের মাত্রা নির্ধারণ করতে পারে। পিসিআর পরীক্ষার ফলাফল খুবই সঠিক এবং বিশ্বাসযোগ্য। ভুল ফলাফল খুবই বিরল। তাই করোনা পরীক্ষা জন্য  পিসিআর পরীক্ষা “গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।

পিসিআর পরীক্ষার কিছু প্রতিকুল দিকও আছে- পরীক্ষাগুলি খরচ সাপেক্ষ এবং পরীক্ষার ফলাফল পেতে ২-৪ দিন সময় লাগে। কারণ পিসিআর পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি এবং সুদক্ষ টেকনিশিয়ানের প্রয়োজন। তাই সমস্থ ল্যাবরেটরিতে পিসিআর পরীক্ষা করা সম্ভব নয়।

র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট (RAT):

র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা পিসিআর পরীক্ষার থেকে নীতি এবং পদ্ধতিগত ভাবে অনেকটাই আলাদা। এই পরীক্ষাটি “ইমিউনো অ্যাসে” নামে পরিচিত। এটি ভাইরাল জিনোমকে সনাক্ত করে না, কিন্তু ভাইরাসের কোন এক নির্দিষ্ট অংশ অর্থাৎ “অ্যান্টিজেন” কে সনাক্ত করে। অ্যান্টিজেন পরীক্ষা পিসিআর পরীক্ষার মতো ভাইরাল অ্যান্টিজেনকে প্রশস্ত করতে পারে না। এমনকি সংগৃহীত নমুনায় অ্যান্টিজেনের মাত্রা কম থাকলে তা সনাক্তও করতে পারে না। বর্তমানে অনেক রকমের র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট বাজারে উপলব্ধ যেগুলো দিয়ে ঘরে বসে প্রায় ৩০-৬০ মিনিটের মধ্যেই ফলাফল জানা যায়। কিন্তু অ্যান্টিজেন পরীক্ষা তাদের ক্ষেত্রে বেশী উপযোগী যাদের শরীরে করোনা সংক্রমণের উপসর্গ দেখা যায়। অন্য দিকে উপসর্গহীন নমুনায় “ফলস পজিটিভ” অর্থাৎ পরীক্ষায় ভাইরাসকে সনাক্ত করা গেলেও বাস্তবে রোগীর দেহে কোন ভাইরাস অস্তিত্ব নেই, এবং “ফলস নেগেটিভ” অর্থাৎ পরীক্ষায় ভাইরাস সনাক্ত করা না গেলেও বাস্তবে রোগীর দেহে করোনা ভাইরাস উপস্থিত আছে। র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় “ফলস পজিটিভ” এবং “ফলস নেগেটিভ” ফলাফলের সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে। তাই কোন ব্যাক্তির র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট নেগেটিভ ফল আসলে তার পিসিআর টেস্ট করে ভাইরাসের উপস্থিতি আছে কিনা নির্ধারণ করা উচিৎ।

বেশ কিছু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার বিশেষ কতগুলি সুবিধেও আছে। কোন জনবহুল অঞ্চলে করোনা সংক্রমণের ধরা পড়লে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে কম সময়ের মধ্যে জনবসতির একটা বড় অংশের করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব। ফলে ভাইরাসের বিস্তার সম্পর্কে চটজলদি একটা ধারনা পাওয়া যায়। এছাড়া সাধারণ স্ক্রিনিং এর জন্য অ্যান্টিজেন পরীক্ষার বেশ উপযোগী।

সুতরাং, পিসিআর পরীক্ষা এবং র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা আলাদা হলেও দুটোরই সুবিধে অসুবিধে আছে। প্রয়োগভেদে দুটো পরীক্ষারই বিশেষ গুরুত্ব আছে। তাই দু’ধরনের পরীক্ষাই নিয়মিতভাবে করা হচ্ছে। আগামী দিনে হয়তো কোন উন্নতমানের পরীক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হতে পারে, যা খরচ কমাবে এবং ফলফলও তাড়াতাড়ি পাওয়া সম্ভব হবে। তাই, কোন পরিস্থিতিতে কোন করোনা পরীক্ষা করা উচিৎ তা জানা খুব জরুরি। আপনার চিকিৎসক বা নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্র আপনাকে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারে।

অ্যান্টিবডি টেস্ট:

অ্যান্টিবডি বা সেরোলজিক্যাল টেস্ট রক্তে অ্যান্টিবডির সন্ধান করে যা করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। এই পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা নেওয়া হয়, যেহেতু অ্যান্টিবডি রক্তে অবস্থান করে। অ্যান্টিবডি এক ধরনের প্রোটিন যা  ভাইরাস আক্রমণের ফলে অথবা ভ্যাকসিন নেওয়ার পর আমাদের দেহে তৈরি হয়। এই অ্যান্টিবডিই করোনা সক্রমনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং ভবিষ্যতে করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে।

অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে শরীরে করোনা সংক্রমণের উপস্থিতি নির্ধারণ করা গেলেও, অ্যাকটিভ ইনফেকশান এই টেস্টের মাধ্যমে সনাক্ত করা যায় না। কারণ শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করে সংক্রমণের কয়েক দিন কিংবা কয়েক সপ্তাহ পর। সেই কারণেই সংক্রমণ হওয়ার পরে শরীরে অ্যান্টিবডির উপস্থিতি জানার জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তাই, প্রাথমিক পর্যায়ে সক্রমন নির্ধারণের জন্য অ্যান্টিবডি টেস্ট অনুমোদন করা হয় না।

ব্যক্তিগতভাবে, আমি করোনা সংক্রমিত অথবা সম্ভাব্য সংক্রামক কিনা জানতে ঘরে বসে বা নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা বেশ সুবিধাজনক এবং দ্রুত পরীক্ষার সমাধান হিসাবে বিবেচনা করি। অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ফল যদি পজিটিভ হয় তবে পিসিআর পরীক্ষা করে তা নির্দিষ্ট করা খুব প্রয়োজন। অন্য দিকে নেগেটিভ অ্যান্টিজেন পরীক্ষা মানেই যে আমার শরীরে করোনা ভাইরাস নেই কিংবা আমি সংক্রমিত নই সেটাও সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। সুতরাং, করোনা পরীক্ষা বা করোনা সংক্রমণের দ্বিধা থাকলে নিজেকে নিভৃতবাসে রাখা সবচেয়ে সুরক্ষিত। এছাড়া নিয়মিত মাস্ক ও স্যানিটাইজারের ব্যাবহার এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনার তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে বা আসবে, সেটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেই ভেবে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। বিজ্ঞানের উপর আস্থা রেখে স্বাস্থ্য এবং সমাজ সচেতনতা গড়ে তুলতে পারলে করোনার বিরুদ্ধে মোকাবিলা অনেকটাই সহজ হবে। সর্বোপরি, করোনা সংক্রান্ত যে কোন উপসর্গ দেখা দিলে করোনা পরীক্ষা করা  বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

Dr. Dipankar Manna

Researcher, University of Oslo, Norway