কম ক্যালোরিযুক্ত সুইটনারের ব্যবহার ডেকে আনতে পারে Type -2 ডায়াবেটিসের বিপদ
নিউক্র্যাড হেলথ বাংলা র নিজস্ব প্রতিবেদন
আমাদের মধ্যে অনেকেরই হয়তো চিনির বিকল্প হিসাবে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় কম ক্যালোরিযুক্ত সুইটনার গ্রহণ করার অভ্যাস রয়েছে। বিশেষতঃ যে সমস্ত ব্যক্তির ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে অথবা যারা অতিমাত্রায় স্বাস্থ্যসচেতন তারা অনেকেই খাদ্যতালিকায় থাকা গ্লুকোজ, সুক্রোজ বা ফুট্রোজ এর জায়গায় কৃত্রিম মিষ্টত্ব বাড়াবার দ্রব্য ব্যবহার করেন, তারা খাবারে তীব্র মিষ্টি স্বাদ নিয়ে আসেন কোনোরকম ক্যালোরিযোগ না করেই। সমীক্ষা করে দেখা গেছে বিগত দুইদশকে low calorie Sweetener (LCS) গ্রহণ করার ঘটনা প্রায় ২০০% বৃদ্ধি পেয়েছে বাচ্ছাদের মধ্যে এবং বড়দের মধ্যে এই গ্রহণ করার শতকরা বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৫৪%। কিন্তু সত্যিটা হলো এই সব কৃত্রিম মিষ্টত্ব বাড়াবার জিনিসগুলি হয়তো দেহের ওজনকে নিয়ন্ত্রনে রাখে অর্থাৎ শারীরিক ওজন সেই অর্থে বাড়ে না কিন্তু এগুলি ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্যের উপর অন্যান্য মারাত্বক ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা।
দীর্ঘদিন ধরে কম ক্যালোরিযুক্ত সুইটনার ব্যবহার মানুষের বিপাক প্রক্রিয়ায় ক্ষতি করে।
স্বনামধন্য সাউথ অস্ট্রেলিয়া ইউনিভার্সিটির একটি গবেষকদের দল দীর্ঘদিন গবেষণা চালিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে নিয়মিত low calorie sweetener গ্রহণ করলে তা ব্যক্তির ওজন কমানোর বদলে আরো বাড়িয়ে দেয় এবং সময়ের সাথে সাথে এই LCS গ্রহণের অভ্যাস ক্রমশ Type 2 ডায়বেটিস বা মধুমেহের মতো রোগ ডেকে আনে।
এই সিদ্ধান্তে আসার অন্যতম কারন হিসেবে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন LCS বা low calorie sweetener আমাদের শরীরের গাট ব্যাকটেরিয়া (Gut Bacteria) অর্থাৎ আমাদের অন্ত্রে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়াদের সংখ্যার অনুপাতকে বদলে দেয় যা আমাদের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও দেখা যাচ্ছে যে যে সমস্ত মানুষজন সুইটনার ব্যবহার করছেন তারা সামগ্রিক মিষ্টি খাবার পরিমানকে আদতঅর্থে কমায় না বরং সুইটনার ব্যবহারকারীদের একপ্রকার মানসিক প্রশান্তি দেয় যে তারা আসলে চিনি না দিয়েই তাদের প্রিয় ফল বা পানীয় অর্থাৎ জুস্ খেতে পারছেন কেবলমাত্র ইচ্ছামত Sweetener ব্যবহার করে। ফলে চিন্তামুক্ত হয়ে যথেচ্ছচারে সুইটনারের ব্যবহার আসলে তাঁদের শরীরে গ্রহণ করা কার্বোহাইড্রেট এর পরিমান বাড়িয়ে দিছে অনেকগুন, হয়তো প্রয়োজনের চেয়ে অনেকটাই বেশী।
কম ক্যালোরিযুক্ত সুইটনার কিভাবে এলো?
১৮৭৯ সালে সর্বপ্রথম কৃত্রিম সুইটনার বা চিনির কৃত্রিম বিকল্প হিসাবে স্যাকারিন তৈরী হয়েছিল। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে স্যাকারিন সুক্রোজের থেকে প্রায় 300 গুন বেশী মিষ্টি এবং এটি তৈরী করার কারন হিসাবে বলা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেহেতু প্রচুর চিনি সৈনিকদের কাছে বন্টনের জন্য চলে যেত, তখন চিনির উৎপাদনে তীব্র সংকট তৈরী হয়েছিল, সেইসময় ইক্ষুজাত দ্রব্যের চাহিদা মেটাতে শিল্প সংস্থাগুলি কৃত্রিম চিনিজাত জিনিস এর উৎপাদন শুরু করলো।
১৯৭০ সালে FDA (Food and Drug Administration) এক সতর্কবার্তায় বলেছিল কৃত্রিম সুইটনারের ব্যবহারে লাগাম টানতে কারন এক কানাডিয়ান সংস্থার সমীক্ষায় স্যাকারিন ব্যবহার ও ব্লাডার ক্যানসার বা মুত্রাশয় ক্যানসারের মধ্যে একটি যোগসুত্র পাওয়া গিয়েছিল। ফলস্বরূপ FDA কর্তৃপক্ষ প্রতিটি স্যাকারিন উৎপাদনকারী সংস্থাকে একটি জনসর্তকবার্তা জারি করার নির্দেশ দিয়েছিল কারণ তারা (FDA) নিজেরাও গবেষণাগারে প্রাণীর উপর দীর্ঘদিন স্যাকারিন ব্যবহারে ক্যানসারের উপসর্গ লক্ষ্য করেছিল। যদিও ভবিষ্যতে এই সতর্কবার্তা তুলে নেওয়া হয়েছিল যেহেতু স্যাকারিনের দীর্ঘ ব্যবহারে ইঁদুরের শরীরে ম্যালিগন্যান্সি বা ক্যানসারে সরাসরি যোগসুত্র প্রমাণিত হয়নি।
বর্তমানে কোন কোন ধরনের সুইটনার (low calorie) ব্যবহার করা হয় ?
বাজারচলতি কয়েকটি প্রচলিত কৃত্রিম সুইটনার এর তালিকা নীচে দেওয়া হল যেগুলি যে কোনো সাধারণ দোকান বা ওষুধের দোকানে সহজলভ্য –
- Aspartame – এটি সুক্রোজের থেকে প্রায় ২০০ গুণ বেশী মিষ্টি এবং এটি Nutrasweet, Equal ও Sugar Twin ব্রান্ড নামে বাজারে বিক্রি হয়।
- Acesulfame Potassium – এটিও সাধারণ চিনির থেকে প্রায় ২০০ গুণ বেশী মিষ্টি ফলে রান্নাও বেকিং এ বেশী ব্যবহৃত হয়। বাজারে এটি বিক্রি হয় Sunnet কিংবা Sweet One ব্রান্ডনামে।
- Advantame – এই কম ক্যালোরিযুক্ত সুইটনারটি সাধারণ চিনির থেকে প্রায় ২০০০০ গুণ বেশী মিষ্টি।
- Neotame – এই সুইটনারটি সুক্রোজের থেকে ১৩০০০ গুণ বেশী মিষ্টি এবং এটি Newtame নামে বাজারে পাওয়া যায়।
- Sacchari – এই কৃত্রিম সুইটনারটি সাধারণ চিনির চেয়ে ৭০০ গুণ বেশী মিষ্টি এবং এটি Sweet’N Low, Necta Sweet বা Sweet Twin নামে পাওয়া যায়।
- Sucralose – সুক্রোজের চেয়ে ৬০০ গুণ বেশী মিষ্টি এই সুইটনারটিকে রান্নায়, বেকিং এ অথবা অ্যাসিডিক বা অম্লজাতীয় খাদ্যসামগ্রীতে যেমন আচার, সস্ ইত্যাদিতে মেশানো হয়।
চিনির বিকল্প হিসাবে প্রাকৃতিক সুইটনার হিসাবে কি কি ব্যবহার করতে পারি আমরা?
একথা আমাদের অনেকেরই জানা যে, চিনি স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক একটি পদার্থ। অত্যাধিক মাত্রায় চিনির ব্যবহার শরীরের ওজন বৃদ্ধি করে, ডায়াবেটিস ঘটায়। ডায়বেটিসে আমরা দেখি মানুষের শরীরে যেকোন ক্ষত বা সংক্রমনের নিরাময় হতে অনেক বেশী সময় লাগে। ফলে চিনির বদলে চিনির স্বাদ যুক্ত কোনো প্রাকৃতিক সুইটনারের ব্যবহার আমাদের দেহের সঠিক স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য ভীষণভাবে উপযোগী, Stevia যেটিকে Stevia Rebaudiana গাছের পাতা থেকে নিষ্কাশন করা হয়, Yacon সিরাপ, মধু, Molasses বা গুড় এবং মেপল্ সিরাপ সুক্রোজের চেয়ে অনেকবেশী উপকারী মানবশরীরের পক্ষে অথচ এদের স্বাদ চিনির থেকে কোনোমাত্রায়ই কম নয়।
সর্বোপরি এটা বলতে বাধা নেই যে চিনি হোক বা চিনির বিকল্প হিসাবে প্রকৃতিতে সহজলভ্য মিষ্টি জাতীয় পদার্থই হোক অতিমাত্রায় গ্রহন করলে তা মানবশরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। আবার কৃত্রিম সুইটনারও একইরকমভাবে মারাত্বক ফলে বুদ্ধিমানের কাজ হলো রোজকার জীবনের সুক্রোজের (প্রাকৃতিক অথবা কৃত্রিম) গ্রহনে লাগাম টানা ও সতর্ক থেকে সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপন করা।