আশা জাগাচ্ছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়-অ্যাস্ট্রাজেনিকার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের হিউম্যান ট্রায়াল রিপোর্ট
ডঃ শুভময় ব্যানার্জী, পি.এইচ.ডি; নিউক্র্যাড হেলথ বাংলা ডেস্ক, জুলাই ২২, ২০২০
কিছুদিন আগেই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) চিফ সায়েন্টিস্ট ডঃ সোমিয়া স্বামীনাথন জানিয়েছিলেন সংস্থার সাথে যুক্ত সদস্য দেশগুলির সাথে আলোচনা করে দেখেছেন কিভাবে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছনো যায়। ভ্যাকসিন গবেষণার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তিনি বলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনিকার ভ্যাকসিন গবেষণা সময়ের নিরীখে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। বিশ্বে নভেল করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি বর্তমানে যথেষ্ট উদ্বেগজনক। কোভিড-১৯ প্রাণ কেড়েছে ছয় লক্ষেরও বেশী মানুষের। আক্রান্তের সংখ্যা বহুদিন আগেই এক কোটি অতিক্রম করেছে। এই সময়ে সারা বিশ্বজুড়ে চলা ভ্যাকসিন গবেষণার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের সহযোগী ব্রিটিশ-সুইডিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনিকার তৈরী ভ্যাকসিন AZD1222 -কে ব্যবহার করা হয় হিউম্যান ট্রায়ালে (ফেজ-I/II)। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন এই ট্রায়ালে যথেষ্ট ভালো ফল পাওয়া গেছে। তাঁদের গবেষনার কাজ বিখ্যাত গবেষণা পত্রিকা “ল্যানসেট” এ প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকার সম্পাদক রিচার্ড হর্টন নিজে টুইট করে জানিয়েছেন এই ভ্যাকসিন শীঘ্রই আসতে চলেছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউফিল্ড ডিপার্টমেন্ট অফ মেডিসিন পরিচালিত জেনার ইনস্টিটিউটে AZD1222 ভ্যাকসিনের গবেষণা শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের প্রজেক্ট “COV001” কে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দেওয়া হয়। নিউফিল্ড মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক প্রধান ডঃ সারা গিলবার্ট জানিয়েছেন এই ভ্যাকসিন তৈরী করতে তাঁরা “ChAdOx1 অ্যাডেনোভাইরাল টেকনোলজি” ব্যবহার করেন। বস্তুতঃ অ্যাডেনোভাইরাস ফুসফুসের উপরের অংশে মৃদু সংক্রমণ ঘটায়। খুব সহজেই একে কোষে প্রবিষ্ট করা যায় বলে এই ভাইরাসটিকে ‘ভেক্টর’ বা বাহক হিসাবে ব্যবহার করা যায়। একে অ্যাডেনোভাইরাল ভেক্টর বলে। সংক্রমণের জন্যে দায়ী জিনগুলিকে বাদ দিয়ে, সেখানে ক্লোনিং করে বসানো হয়েছে SARS-CoV-2 এর স্পাইক প্রোটিন গঠনকারী জিন। ডঃ গিলবার্টের মতে, অ্যাডেনোভাইরাসের এই স্ট্রেনটি এক প্রজাতির শিম্পাঞ্জির থেকে নেওয়া। এটি মানুষকে আক্রমণ করে না। ফলে এই স্ট্রেনের বিরুদ্ধে কোন রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। ফলে এই ভেক্টর ভ্যাকসিন তৈরীতে খুবই উপযুক্ত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ChAdOx1 অ্যাডেনোভাইরাল টেকনোলজি পূর্বেও ফ্লু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস ও মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম (MERS) সংক্রমণের ভ্যাকসিন হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। বর্তমানে ভ্যাকসিনটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ফেজ-III শুরু হয়েছে ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলে। আমেরিকাতেও এই ট্রায়াল কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন তাঁদের ভ্যাকসিন কোভিড-১এর বিরুদ্ধে দুইভাবে কাজ করতে পারে। প্রথমত: AZD1222 ভ্যাকসিন মানুষের শরীরে নিউট্রিলাইজিং অ্যান্টিবডি তৈরী হতে সাহায্য করে, দ্বিতীয়ত: ভ্যাকসিনটি কিলার টি-লিম্ফোসাইট (Cytotoxic T-lymphocyte) তৈরী করতে বিশেষ ভূমিকা নেয়। অন্যান্য গবেষণা বলছে, এই কিলার টি-লিম্ফোসাইট শরীরে অনেক বেশী সময় ধরে থাকতে পারে এবং ভাইরাস আক্রান্ত কোষকে চিহ্নিত করে তাকে ধ্বংস করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ১,০৭৭ জন সুস্থ মানুষের উপর (বয়সসীমা: ১৮-৫৫) AZD1222 ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালানো হয়। গবেষণাপত্রে প্রকাশিত ট্রায়ালের ফল অনুযায়ী, প্রথম ভ্যাকসিন ডোজ দেবার একমাসের মধ্যেই শতকরা ৯৫ জন মানুষের মধ্যে SARS-CoV-2 এর বিরুদ্ধে প্রায় চার গুন বেশী অ্যান্টিবডি তৈরী হয়। এছাড়াও ভ্যাকসিনেশানের ১৪ দিনের মাথায় সর্বোচ্চ টি-লিম্ফোসাইটের রেসপন্স দেখা দেয় এবং তা দুই থেকে তিন মাস পর্যন্ত বজায় থাকে। অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন ট্রায়ালের চিফ ইনভেস্টিগেটর অধ্যাপক অ্যানড্রু পোলার্ড জানিয়েছেন, AZD1222 ভ্যাকসিনের বিশেষ কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এই ভ্যাকসিন শুধুমাত্র নভেল করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরী করে, তবে আরো ট্রায়ালের প্রয়োজন ভ্যাকসিনটির বিশদ কার্যকারিতা জানার জন্যে। অ্যাস্ট্রাজেনিকার তরফ থেকে বলা হয়েছে শেষ পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সাফল্য লাভ করলেই তারা দুই বিলিয়ন ভ্যাকসিন ডোজ ব্রিটেন, ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত ও অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে দেবে। ইতিমধ্যেই ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার সাথে তাদের এই ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বিশ্বের সব বিজ্ঞানীদের সাথে সাধারণ মানুষও চেয়ে আছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের দিকে।
তথ্যসূত্রঃ
- https://www.sciencedirect.com/science/article/pii/S0140673620316044
- https://www.who.int/publications/m/item/draft-landscape-of-covid-19-candidate-vaccines
- Folegatti PM, Bittaye M, Flaxman A, et al. Safety and immunogenicity of a candidate Middle East respiratory syndrome coronavirus viral-vectored vaccine: a dose-escalation, open-label, non-randomised, uncontrolled, phase 1 trial [published correction appears in Lancet Infect Dis. 2020 May 12;:] [published correction appears in Lancet Infect Dis. 2020 Jun 8;:]. Lancet Infect Dis. 2020;20(7):816-826. doi:10.1016/S1473-3099(20)30160-2
- Lane R. Sarah Gilbert: carving a path towards a COVID-19 vaccine. Lancet. 2020;395(10232):1247. doi:10.1016/S0140-6736(20)30796-0
- Mullard A. COVID-19 vaccine development pipeline gears up. Lancet. 2020;395(10239):1751-1752. doi:10.1016/S0140-6736(20)31252-6
- https://www.astrazeneca.com/media-centre/press-releases/2020/covid-19-vaccine-azd1222-showed-robust-immune-responses-in-all-participants-in-phase-i-ii-trial.html
- https://www.ovg.ox.ac.uk/
- https://www.ox.ac.uk/news/2020-07-20-new-study-reveals-oxford-coronavirus-vaccine-produces-strong-immune-response