ডিসেম্বর 23, 2024

আধুনিক গবেষণায় মানসিক অবসাদের উৎস ও কারন অনুসন্ধান

mental-health-2313430_1920
Reading Time: 5 minutes

ডঃ শুভময় ব্যানার্জী, নিউক্র্যাড হেলথ বাংলা ২৯ জুন, ২০২০

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) একটি সাম্প্রতিক তথ্য চিন্তায় ফেলেছে আমাদের সবাইকে। সেটা হোল, বর্তমানে সারা পৃথিবীর ২৬ কোটিরও বেশী মানুষ মানসিক ও স্নায়ুরোগের শিকার। এদের মধ্যে বেশীরভাগ মানুষই ‘ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার’ (Depressive Disorder)-এ আক্রান্ত বা মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ। মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশান এমন এক অসুখ যা মানুষের বয়স, সুস্বাস্থ্য, সামাজিক খ্যাতি, আর্থিক সচ্ছলতা কোনকিছুর উপরেই নির্ভরশীল নয়। চূড়ান্ত প্রাণোচ্ছল, জীবনে সফল ও প্রতিষ্ঠিত মানুষও নিজের এবং পরিবার-পরিজনের অজান্তেই আক্রান্ত হতে পারেন এই অদ্ভুত, ভয়াবহ মানসিক অবসাদে। দুঃখের কথা, সমাজের বেশীরভাগ মানুষ আজও মানসিক অবসাদের গুরুত্ব বুঝতে না পেরে, এবং এই রোগটিকে লজ্জার চোখে দেখে, মানসিক রোগীর কোন চিকিৎসা করান না, ফলে রোগী আরও গভীর অবসাদের দিকে চলে যায়। অনেক সময়, স্বয়ং রোগীও নিজের অবস্থার গুরুত্ব ও পর্যায় (Stages of Depression) বুঝতে না পেরে চরম হতাশা এবং আত্মহত্যা প্রবনতার শিকার হন।

মানসিক অবসাদের অনেকগুলি কারনের মধ্যে, এই আলোচনায় মুলতঃ জৈবিক কারনগুলি নিয়ে বিচারবিবেচনা করা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণা জানাচ্ছে, মানসিক অবসাদ তৈরির পিছনে কোন ব্যাক্তির জিনগত (Genetic) সমস্যা, মস্তিষ্কের জৈব-রাসায়নিক উপাদানগুলির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা (Imbalance in Bio-chemical components), বিভিন্ন ড্রাগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (Side-effects of Drugs), ক্রমাগত দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ (Mental Stress) বিশেষ ভাবে কাজ করে। আশ্চর্যের ব্যপার হোল, দুটি মানুষের একই ধরনের মানসিক অবসাদের লক্ষন ও উপসর্গ প্রকাশ পেলেও তার কারনগুলি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির হতে পারে। কেন এই তফাৎ? এর বৈজ্ঞানিক কারন হোল, প্রতিটি মানুষের শরীরে অবস্থিত কোটি কোটি স্নায়ুকোষ এবং তাদের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলা স্নায়ু-সংযোগের গতি (Speed of Neural Communication) ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। শুধু তাই নয়, স্নায়বিক নিয়ন্ত্রনে, মস্তিষ্কের কোষে ঘটে চলা বিভিন্ন জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়া যা, মানুষের সুখ, দুঃখ, স্পর্শ, চিন্তার সমস্ত অনুভূতিকে সবসময়ে নিয়ন্ত্রন করে, তার প্রকৃতিও স্বত্রন্ত্র। বলাই বাহুল্য, এর ফলে মানসিক অবসাদের চিকিৎসাও প্রতিটি রোগীর জন্যে সুনির্দিষ্ট।

মানসিক অবসাদের জৈবিক কারন অনুসন্ধান

১) জিনগত সমস্যাঃ

Dna, Doctor, Lab, Helix, Biology

বিজ্ঞানীদের গবেষণায়, বেশ কিছু জিনকে শনাক্ত করা গেছে যারা মানসিক অবসাদের জন্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দায়ী। এই সমস্ত জিনগুলির মধ্যে, DRD4 (ডোপামাইন রিসেপ্টর ডি-4), SLC6A3 (সলিউট ক্যারিয়ার ফ্যামিলি-6 মেম্বার-3), SLC6A4 (সলিউট ক্যারিয়ার ফ্যামিলি-6 মেম্বার-3), TPH2 (ট্রিপটোফ্যান হাইড্রক্সিলেজ-2)  ইত্যাদি প্রধান। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই জিন গুলিকে ডিপ্রেশানের ‘জেনেটিক মার্কার’ বলা হয়। গবেষকরা দেখেছেন, এই জিনগুলি ১-৩% বেশী প্রভাব ফেলে মানসিক অবসাদগ্রস্থ পিতা-মাতা এবং তাদের সন্তানদের উপর। বস্তুতঃ মানসিক অবসাদ বংশ পরম্পরায় কিভাবে সঞ্চারিত হয় তার পুঙ্খনাপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনায় আধুনিক জিন-গবেষণা (Genetic Research) স্নায়ুরোগ চিকিৎসকদের প্রভূত সাহায্য করছে। প্রতিটি অবসাদগ্রস্থ মানুষের জেনেটিক প্রোফাইল তৈরি করে, এই জিনগুলির ব্যাবহার পর্যবেক্ষণ করলে, তাদের জন্যে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা সম্ভব।  

২) নিউরোট্রান্সমিটার ও মানসিক অবসাদঃ

মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলি পরস্পরের মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদান ও তার নিয়ন্ত্রন বজায় রাখে যে রাসায়নিক উপাদানগুলির সাহায্যে, তাদের ‘স্নায়ুকোষের রাসায়নিক-দূত’ বা নিউরোট্রান্সমিটার (NT) বলে। বিজ্ঞানীরা কিছু কিছু অতি প্রয়োজনীয় নিউরোট্রান্সমিটারের সন্ধান পেয়েছেন যাদের কার্যপ্রণালীর হেরফেরে মানুষের শরীরে মানসিক অবসাদ আসতে পারে। যেমন-

সেরোটোনিন– মানুষের খিদে, ঘুম, যৌন ইচ্ছে, ব্যাথার অনুভূতি ইত্যাদি কাজের নিয়ন্ত্রক। বর্তমান গবেষণায় প্রমানিত, শরীরে এই সেরোটোনিনের কম উৎপাদনে মানসিক অবসাদ আসতে পারে।

ডোপামাইন– কাজের ইচ্ছে জাগিয়ে তোলে, আলস্য আসতে দেয়না। দেখা গেছে, কম মাত্রার ডোপামাইন মানসিক অবসাদে আনন্দ-অনুভূতি অনেকটাই কমিয়ে দেয়।

নরএপিনেফ্রিন– পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপ সামলাতে বিশেষ কার্যকরী। নর-এপিনেফ্রিনের মাত্রা ভীষণ ভাবে কমে গেলে, মানসিক অবসাদে প্রতিকূল পরিবেশের চাপ নেওয়ার ক্ষমতাও কমে যায়।

গ্লুটামেট– অত্যন্ত জরুরী নিউরোট্রান্সমিটার। শরীরে এর কম মাত্রায়, স্নায়ু যোগাযোগ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে মানসিক অবসাদ ও নান প্রকার স্নায়ু-বিকার (Mania) দেখা দেয়।

গামাঅ্যামিনো বিউটাইরিক অ্যাসিড (GABA)– এই জাতীয় নিউরোট্রান্সমিটার স্নায়ু উদ্দিপনাকে কমিয়ে এনে দুশ্চিন্তা দূর করতে সাহায্য করে। এর মাত্রার হেরফেরে, মানসিক অবসাদ আসতে পারে।

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, স্নায়ুকোষে এই সমস্ত নিউরোট্রান্সমিটারের যে রিসেপ্টরগুলি অবস্থিত, তাদের সংবেদনশীলতার (Sensitivity) কম-বেশীর জন্যে মানসিক অবসাদ প্রভাবিত হয়।

3) মস্তিস্ক ও মানসিক অবসাদঃ

Acetylcholine Pathway.png

মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ মানুষের মন ও জৈবিক কাজ নিয়ন্ত্রনে প্রধান ভূমিকা নেয়। বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের গঠন ও তার বিভিন্ন অংশের পর্যালোচনার জন্যে নানা আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নেন, যেমন- পজিশন এমিশন টোমোগ্রাফি (PET), সিঙ্গল-ফোটন এমিশন কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি (SPECT), ফাংশানাল ম্যাগনেটিক রেজনেন্স ইমেজিং (fMRI) স্ক্যান ইত্যাদি।

অ্যামিগডালা– মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের প্রধান অংশ। এই স্থান মানুষের ক্রোধ, আনন্দ, দুঃখ, যৌন উত্তেজনা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশান যাদের আছে, তাদের ক্ষেত্রে এই অংশটি মাত্রাতিরিক্ত কার্যক্ষম হয়।

থ্যালামাস– উত্তেজক অনুভূতি গ্রহন করে, মস্তিষ্কের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি স্নায়ুসংবেদন সেরিব্রাল কর্টেক্সে পাঠিয়ে দেয়। এর ফলে মানুষের কথা বলা, ব্যাবহার, চিন্তা, শিক্ষার মতো জটিল কাজগুলি দক্ষতার সাথে নিয়ন্ত্রিত হয়। গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে, থ্যালামাসের আকার ও আয়তনের পরিবর্তনে, মানুষের ‘মেজর ডিপ্রেশিভ ডিসঅর্ডার’ (MDD) হয়ে থাকে।

হিপ্পোক্যাম্পাস– এটিও মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানুষের দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি (Long-term memories) রক্ষণাবেক্ষণ ও সেই স্মৃতির রোমন্থনে (Re-collection) হিপ্পোক্যাম্পাস বিশেষ ভাবে দায়ী। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, মানসিক অবসাদগ্রস্থ রোগীর হিপ্পোক্যাম্পাসের আকার ছোট হয় এবং স্নায়ুকোষ তৈরির হার ভীষণ ভাবে কম হয়।

http://www.neucrad.com

) মানসিক অবসাদে হরমোনের প্রভাবঃ

মানসিক চাপ অনুভব করলে, মানুষের শারীরবৃত্তিয় ক্রিয়াগুলির (Physiological Processes) যেমন-হৃদস্পন্দন, পেশী সংকোচন, শ্বাসপ্রশ্বাস ইত্যাদির কাজ বিঘ্নিত হয়। একে ‘স্ট্রেস রেস্পন্স’ বলে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোল, মানসিক চাপ দূরীভূত হলে, শরীর আগের অবস্থায় ফিরে আসে। কিন্তু, ক্রমাগত মানসিক চাপ অনুভব করলে, হরমোন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং গভীর মানসিক অবসাদ তৈরি হয়।

অ্যাড্রেনোকর্টিকোট্রপিক হরমোন– মানসিক চাপে, হাইপোথ্যালামাস-পিটুইটারি-অ্যাড্রেনাল অক্ষ (HPA) অনেকগুলি হরমোনের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রন করে। এটি কর্টিকোট্রপিন রিলিজিং হরমোন বা CRH নিঃসরণ করে, অ্যাড্রেনোকর্টিকোট্রপিক হরমোন তৈরিতে সাহায্য করে। এই হরমোন অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে ‘কর্টিসল’ হরমোন নিঃসরণ করে যা মানুষকে মানসিক চাপের মোকাবিলা করার ক্ষমতা যোগায়। গবেষণায় পাওয়া গেছে, মানসিক অবসাদে রক্তে ‘কর্টিসল’ হরমোন আর কর্টিকোট্রপিন রিলিজিং হরমোনের পরিমান ভীষণ ভাবে বেড়ে যায়।

থাইরয়েড হরমোন– এই হরমোনটির ভারসাম্যহীনতা মানসিক অবসাদে সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে। হরমোনটির অধিক ক্ষরণে অর্থাৎ ‘হাইপার-থাইরয়েডিজম’ রোগে, মানসিক বিকারের উপসর্গ লক্ষ্য করা যায়। আবার এর অত্যাধিক কম ক্ষরণে বা ‘হাইপো-থাইরয়েডিজম’ রোগে, জড়তা ও মানসিক অবসাদের লক্ষনগুলি ফুটে ওঠে।

) বিভিন্ন রোগ মানসিক অবসাদঃ

চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণায় (Medical Research) বিভিন্ন রোগের সাথে মানসিক অবসাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগ পাওয়া গেছে। নানা স্নায়ুসমস্যা জনিত রোগে, যেমন- মাল্টিপ্যাল স্কেরোসিস, পারকিনসন্স ডিজিজ, অ্যালঝেইমার’স ডিজিজ, হান্টিংটন’স ডিজিজ এছাড়া, হৃদপিণ্ডের নানা সমস্যায়, ভিটামিন বি-১২ এর ঘাটতিতে, দুর্বল ইমিউনিটির জন্যে, HIV- ভাইরাসের সংক্রমণে, কান্সারে মানসিক অবসাদ দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন যৌনরোগ ও যৌনাঙ্গের নানা সমস্যাও মানসিক অবসাদের আর একটি বড় কারন বলে মনে করা হয়। বৈজ্ঞানিক হিসাব অনুযায়ী, অন্য রোগগুলির সাথে, মানসিক অবসাদের ১০-১৫% সম্পর্ক আছে। বর্তমান পরিস্থিতির নিরিখে এটি সত্যিই ভাবার বিষয়।

আজ মানসিক অবসাদ শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক ব্যাধিও বটে। মানসিক রোগীর প্রতি অবহেলা, অযত্ন, অত্যাচার প্রতিদিনের খবর। জনসাধারণ এখনো মানসিক রোগ ও অবসাদের সম্পর্কে ভালোভাবে সচেতন নন। মানসিক অবসাদের চিকিৎসা ধৈর্যসাপেক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যায়বহুলও বটে। বহু ক্ষেত্রেই, মানসিক রোগের চিকিৎসাপদ্ধতি ও ওষুধ নির্বাচনের ভুলে রোগ অনেকগুণ বেড়ে যেতে পারে। তাই যথোপযুক্ত চিকিৎসা পরিসেবা, সঠিক ওষুধ, নিয়মিত কাউন্সেলিং এবং সর্বোপরি সংবেদনশীল মন নিয়ে মানসিক অবসাদগ্রস্থ রোগীর পাশে এসে দাঁড়ালে, তারা আরোগ্যের পথে এগিয়ে যাবে।  

 তথ্য সুত্রঃ

  1. https://www.who.int/news-room/fact-sheets/detail/depression
  2. https://www.verywellmind.com/common-causes-of-depression-1066772
  3. https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK215119/
  4. Shadrina M, Bondarenko EA, Slominsky PA. Genetics Factors in Major Depression Disease. Front Psychiatry. 2018;9:334. Published 2018 Jul 23. doi:10.3389/fpsyt.2018.00334
  5. Pandya M, Altinay M, Malone DA Jr, Anand A. Where in the brain is depression?. Curr Psychiatry Rep. 2012;14(6):634-642. doi:10.1007/s11920-012-0322-7
  6. Nutt DJ. Relationship of neurotransmitters to the symptoms of major depressive disorder. J Clin Psychiatry. 2008;69 Suppl E1:4-7.
  7. Brigitta B. Pathophysiology of depression and mechanisms of treatment. Dialogues Clin Neurosci. 2002;4(1):7-20.

লেখক পরিচিতিঃ 

ডঃ শুভময় ব্যানার্জী

ডঃ শুভময় ব্যানার্জী দিল্লি-র অ্যামিটি ইউনিভার্সিটি-তে ভাইরোলজি এবং ইমিউনোলজি বিভাগে  অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করেছেন। উনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যান্সার বায়োলজিতে পিএইচডি এবং পরবর্তীকালে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া-র স্কুল অফ মেডিসিন-এ এবং সিটি অফ হোপ ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট-এ (ক্যালিফর্নিয়া) ভাইরাল অনকোলজি বিষয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষণা করেন। সম্প্রতি লেখক অধ্যাপনা, লেখালিখি, ক্যান্সার গবেষণা ও সচেতনতা প্রসারের কাজে যুক্ত।