ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ ও সচেতনতা: একটি প্রাসঙ্গিক আলোচনা
শুভময় ব্যানার্জী, পিএইচডি, নিউক্র্যাড হেলথ এর প্রতিবেদন, ১৫ অক্টোবর , ২০২০
এই সময়ে সারা বিশ্বে, যখন মানুষ কোভিড-১৯ সংক্রমণের আশঙ্কায় প্রবলভাবে চিন্তিত, সেই সময়ে নিঃশব্দে, অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে ব্রেস্ট বা স্তনগ্রন্থির ক্যান্সার। ভারতীয় পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ব্রেস্ট ক্যান্সারের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য অনুযায়ী এতদিন পর্যন্ত জরায়ুর ক্যান্সারে মহিলাদের মৃত্যু হতো সর্বাধিক, কিন্তু বর্তমানে দেখা গেছে জরায়ুর ক্যান্সারকে সরিয়ে প্রথমস্থানে উঠে এসেছে ব্রেস্ট ক্যান্সার। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের (ICMR) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল পর্যন্ত ভারতে ব্রেস্ট ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৪.৫ লক্ষ যেখানে ২০২০ সালেই তা ১৭.৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে বলে বৈজ্ঞানিকদের আশঙ্কা!
কিন্তু কিভাবে ধরা যায় ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং তার প্রতিরোধের উপায় কি- এই প্রসঙ্গে হয়তো অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। আসুন, জেনে নেওয়া যাক গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলি।
ব্রেস্ট ক্যান্সার ও তার পর্যায়:
স্তনগ্রন্থির কোষগুলির অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনের ফলে দেখা দেয় টিউমার। সেই টিউমার থেকে কোষগুলি রক্তসংবহন পথে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে অন্য অঙ্গে নতুন করে টিউমার সৃষ্টি করলে, তাকে বলে মেটাস্ট্যাটিক ব্রেস্ট ক্যান্সার। প্রধানতঃ সরাসরি স্তনগ্রন্থিতে মেটাস্ট্যাটিক টিউমার দেখা দিলে তাকে বলে লোবিউলার কার্সিনোমা এবং স্তনগ্রন্থির নালিকাগুলিতে ক্যান্সার হলে তাকে বলে ডাকটাল কার্সিনোমা। আশ্চর্যের ব্যাপার, নারী ও পুরুষ উভয়েরই ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে, তবে পুরুষদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা ১%। গবেষণায় দেখা যায় দুই-তৃতীয়াংশ মহিলাদের মধ্যে যাদের বয়স ৫৫ বা তার উর্ধে, তাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা বেশী। বাকি এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে, ৩৫-৫৪ বছর বয়সীদেরও ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে দেখা যায়।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের মোট চারটি পর্যায় দেখা যায়। যেমন-
স্টেজ-১ ব্রেস্ট ক্যান্সারঃ
এই পর্যায়ে টিউমারের আকার খুব ক্ষুদ্র থাকে এবং তা স্তনগ্রন্থির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সময়মত উপযুক্ত চিকিৎসায় নিরাময় সম্ভব।
স্টেজ-২ ব্রেস্ট ক্যান্সারঃ
টিউমার ২ সেন্টিমিটার আকারের হয়। স্থানীয় লসিকাগ্রন্থিগুলি এবং বুকের পাঁজরের হাড়গুলি ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
স্টেজ-৩ ব্রেস্ট ক্যান্সারঃ
টিউমার আকারে বেড়ে গিয়ে ৫ সেন্টিমিটারের হয়ে যায়। স্তনগ্রন্থির চারপাশের কোষকলা এবং বহুসংখ্যক লসিকাগ্রন্থি আক্রান্ত হয়।
স্টেজ-৪ ব্রেস্ট ক্যান্সারঃ
এই পর্যায়ে, টিউমারের আকার যাই হোক না কেন, ব্রেস্ট ক্যান্সার কোষগুলি সারা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে যেমন- ফুসফুস, যকৃৎ, অস্থি, এমনকি মস্তিস্কেও ছড়িয়ে পড়ে। এই পর্যায়ে রোগীর জীবনের যথেষ্ট ঝুঁকি থাকে।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের লক্ষনসমূহঃ
- স্তনগ্রন্থিতে বা তার কাছে দীর্ঘস্থায়ী শক্ত ফোলাভাব।
- স্তনগ্রন্থির আকার ও আকৃতির পরিবর্তন।
- স্তনগ্রন্থির থেকে হলুদ বা রক্তবর্ণের নিঃসরণ।
- স্তনবৃন্তের ত্বকের রঙ পরিবর্তন ও জ্বালাভাব।
- স্তনবৃন্তের আকার ও আকৃতির পরিবর্তন।
এই লক্ষণগুলি দেখা মাত্রই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
ব্রেস্ট ক্যান্সারের কারন ও প্রতিরোধ ব্যাবস্থাঃ
ঠিক কি কারনে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয় তা এখনো খুব স্পষ্ট নয়। গবেষণায় জানা যায়, ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিভিন্ন কারনের মধ্যে, বয়স, জেনেটিক সমস্যা, হরমোন ভারসাম্যহীনতা, ডায়েট ইত্যাদি প্রধান।
বিজ্ঞানীরা ব্রেস্ট ক্যান্সার কোষ নিয়ে গবেষণাগারে পরীক্ষা করে কিছু জিন এবং কোষীয় প্রোটিনের কথা জানিয়েছেন যাদের শরীরে ব্রেস্ট ক্যান্সার দেখা দেবার বিশেষ কারণ হিসাবে গণ্য করা হয়।
এই কারণ বা ফ্যাক্টরগুলি হলো-
১. ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর (ER) এবং প্রোজেস্টেরন রিসেপ্টর (PR): ব্রেস্ট ক্যান্সার কোষে এই দুই হরমোন রিসেপ্টরের আধিক্য দেখা যায়। এছাড়া, মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের অধিক ক্ষরণে ইস্ট্রোজেন রিসেপ্টর মাত্রাতিরিক্ত সক্রিয়তা লাভ করে এবং স্তনগ্রন্থির কোষগুলিতে ক্রমাগত আণবিক সংকেত (Molecular Signaling) পাঠাতে থাকে, ফলে কোষগুলি অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বিভাজিত হয়ে টিউমার তৈরী করে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, শিশুকে স্তন্যপান করানোর সময়ে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমান কমে যায়, এর সাথে সাথে মহিলাদের ঋতুচক্রের ব্যবধান বেড়ে যায়। ফলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার প্রবণতা কম হয়।
২. হিউম্যান এপিডার্মাল গ্রোথ ফ্যাক্টর রিসেপ্টর-২ (HER-2): এই টাইরোসিন কাইনেজ গোত্রের প্রোটিন রিসেপ্টরটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। সাধারণ ভাবে কোন রিসেপ্টর তার সাথে ‘লাইগ্যান্ড অনু’ (Ligand Molecule) যুক্ত হবার পর সক্রিয় হয় ও কোষে আণবিক সংকেত পাঠাতে থাকে। কিন্তু এই রিসেপ্টরটি লাইগ্যান্ড ছাড়াই নিজে সর্বদা সক্রিয় থাকে, ফলে কোষের মধ্যে ক্রমাগত কোষবিভাজনের সংকেত যায় ও টিউমার তৈরী হয়।
৩. কি-৬৭ অ্যান্টিজেন (Ki-67 Antigen): এই বিশেষ অ্যান্টিজেনটি কোষচক্রের গুরুত্বপূর্ণ দশাগুলির মাঝে (মূলত এস-ফেজ বা সংশ্লেষ দশায়) প্রকাশ পায় ও কোষগুলিকে দ্রুত বিভাজিত হতে সাহায্য করে।
৪. টিউমার প্রোটিন ৫৩ (TP53): অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রোটিনটি ক্যান্সার প্রতিহত করে, তাই একে “টিউমার সাপ্রেসর প্রোটিন” (Tumor Suppressor Protein) বলে। ব্রেস্ট ক্যান্সার কোষে TP53 প্রোটিনের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয় (প্রধানত মিউটেশনের জন্যে) ফলে কোষবিভাজন অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে।
৫. ব্রেস্ট ক্যান্সার সাসেপ্টিবিলিটি জিন ফ্যামিলি (BRCA1/BRCA2): এই জিনগুলি থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন টিউমার সাপ্রেসর হিসাবে কাজ করে। এদের প্রধান কাজ কোষীয় বিভাজন, কোষ পার্থক্য (Cell Differentiation), কোষচক্র ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা। BRCA1/BRCA2 জিনগুলির মিউটেশনের ফলে নিষ্ক্রিয় বা অস্বাভাবিক প্রোটিন তৈরী হয় এবং কোষের প্রয়োজনীয় কাজে ব্যাঘাত করে ক্যান্সার তৈরী করে।
ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের উপায়:
রোগীকে পরীক্ষা করে চিকিৎসক ব্রেস্ট ক্যান্সার সন্দেহ করলে তিনি ম্যামোগ্রাম, এমআরআই, আলট্রাসাউন্ড ইমেজিং করে এবং বায়োপসির সাহায্যে ক্যান্সার নির্ধারণ করতে পারেন। ইমিউনো-হিস্টোপ্যাথলজির সাহায্যে ব্রেস্ট ক্যান্সারের পর্যায় জানা যায়। এর পর প্রয়োজন মতো সার্জারি, রেডিয়েশান এবং বিভিন্ন কেমোথেরাপিউটিক ড্রাগ (Tamoxifen, Raloxifene, Aromatase Inhibitor, EGFR-Blocker) ব্যবহার করে ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসা করা হয়। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অনুযায়ী ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার কিছু কারণ বা ফ্যাক্টর আমাদের হাতে নেই, আবার কিছু ফ্যাক্টর আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। যেমন-
নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য কারণসমূহ:
বয়স, স্তনের জন্মগত আকার, জাতিগত কারণ (শ্বেতাঙ্গ মহিলারা বেশী ব্রেস্ট ক্যান্সারপ্রবন!), রেডিয়েশান থেরাপি, জেনেটিক মিউটেশন (পিতা-মাতার BRCA1/2, HER-2, CHK-2, TPP53 ইত্যাদি মিউটেশন থাকলে), পুরোনো কোন জটিল রোগ থাকলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে। এই কারণগুলোকে পরিবর্তিত করা যায় না।
নিয়ন্ত্রণ যোগ্য কারণসমূহ:
রোজ কিছুটা সময় ব্যায়াম করা উচিত। রোজকার জীবনযাত্রা যত সক্রিয় হবে, ততই ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার সুযোগ কমবে। মদ্যপান বর্জন করতে হবে, দেখা গেছে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানে মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে। এছাড়া মেনোপজ বা ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যাবার পর, মহিলাদের অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা থাকে, এতে ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে পারে। এছাড়াও যৌনজীবনে ক্রমাগত কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল ও হরমোন ব্যবহারে ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সুযোগ থাকে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, মহিলারা ত্রিশ বছর পরে সন্তানধারণ করলে এবং শিশুকে স্তন্যপান না করালে ব্রেস্ট ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
সর্বোপরি, ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিহত করতে চাই ব্যাপক গবেষণা ও জনসচেতনতা। অত্যাধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন স্টেজ-৪ ব্রেস্ট ক্যান্সার রোগীকেও উপযুক্ত থেরাপির সাহায্যে বেশ কিছু বছর সুস্থভাবে জীবনদানে সক্ষম হয়েছে। জেনেটিক কাউন্সেলিং এর সাহায্যে এখন অনেক আগে থেকেই কোন মহিলার ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্ভাবনা বলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। সেই অনুযায়ী অগ্রিম চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কাৰ্যক্ষেত্রে সর্বত্র সচেতনতামূলক প্রচারের প্রয়োজন। তবেই সুস্থ, সক্রিয় ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মাধ্যমে আমরা ব্রেস্ট ক্যান্সারকে প্রতিহত করতে পারবো।
তথ্যসূত্রঃ
- Sun YS, Zhao Z, Yang ZN, et al. Risk Factors and Preventions of Breast Cancer. Int J Biol Sci. 2017;13(11):1387-1397. Published 2017 Nov 1. doi:10.7150/ijbs.21635
- Sharma GN, Dave R, Sanadya J, Sharma P, Sharma KK. Various types and management of breast cancer: an overview. J Adv Pharm Technol Res. 2010;1(2):109-126.
- Feng Y, Spezia M, Huang S, et al. Breast cancer development and progression: Risk factors, cancer stem cells, signaling pathways, genomics, and molecular pathogenesis. Genes Dis. 2018;5(2):77-106. Published 2018 May 12. doi:10.1016/j.gendis.2018.05.001
- Akram M, Iqbal M, Daniyal M, Khan AU. Awareness and current knowledge of breast cancer. Biol Res. 2017;50(1):33. Published 2017 Oct 2. doi:10.1186/s40659-017-0140-9
- Gupta A, Shridhar K, Dhillon PK. A review of breast cancer awareness among women in India: Cancer literate or awareness deficit?. Eur J Cancer. 2015;51(14):2058-2066. doi:10.1016/j.ejca.2015.07.008
- Moo TA, Sanford R, Dang C, Morrow M. Overview of Breast Cancer Therapy. PET Clin. 2018;13(3):339-354. doi:10.1016/j.cpet.2018.02.006
- Waks AG, Winer EP. Breast Cancer Treatment: A Review. JAMA. 2019 Jan 22;321(3):288-300. doi: 10.1001/jama.2018.19323. PMID: 30667505.