করোনার উপসর্গের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে অন্যান্য অসুখের উপসর্গের
পল্লব সাধুখাঁ নিউক্র্যাড হেলথ বাংলা, আগস্ট ১৬, ২০২০
‘করোনা’ শব্দটি এখন সারা বিশ্বের কাছে এক ত্রাস। সারা বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে প্রায় দু কোটির কাছাকাছি। উৎপত্তিস্থল চীনের য়ুহান প্রদেশ হলেও, এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশেই।
কমবেশি বিশ্বের সকল মানুষই আতঙ্কিত এই করোনাভাইরাস নিয়ে। যে হারে এই ভাইরাস সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ে চিন্তিত বৈজ্ঞানিক মহলও। বিভিন্ন দেশে শোনা যাচ্ছে গোষ্ঠী সংক্রমণের সম্ভাবনা। এই গোষ্ঠী সংক্রমনের পেছনে কারণ অসংখ্য। প্রথমত, মানুষের সচেতনতার অভাব এবং দ্বিতীয়তঃ, করোনার উপসর্গের সঙ্গে মিল পাওয়া যাচ্ছে অন্যান্য অসুখের উপসর্গের। স্বভাবতই, বিভ্রান্ত হচ্ছেন আমজনতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, সাধারণ জ্বর, সর্দি কাশির উপসর্গ দেখেই করোনা আক্রান্ত হাওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকেই। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বহুলাংশে থেকে যায়। তাই সাধারণ জ্বর বা সর্দি-কাশি হলেও ডাক্তাররা পরামর্শ দিচ্ছেন ন্যূনতম ১৪ দিন হোম কোয়ারান্টিনে থাকার এবং সত্বর করোনা পরীক্ষা করার।
করোনার কিছু উপসর্গের মধ্যে প্রধান উপসর্গগুলি হলো:-
- শ্বাসকষ্ট
- কাশি ও সর্দি
- জ্বর (মূলত ১০০°F এর কাছাকাছি)
তাছাড়াও, অন্যান্য উপসর্গ গুলি হল:-
- গলা ব্যথা
- স্বাদ এবং ঘ্রাণের অবনমন
- মাথা যন্ত্রণা ইত্যাদি
সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই দেখা যাচ্ছে যে, অন্যান্য অসুখের উপসর্গের সঙ্গে বহুলাংশে মিল রয়েছে করোনার উপসর্গের।
১. শ্বাসকষ্ট:-
করোনার অন্যতম প্রধান উপসর্গ হল শ্বাসকষ্ট। SARS-CoV-2 ভাইরাস সাধারনত মানবদেহে ফুসফুস কে আক্রমণ করে। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই দেখা যায় শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ। কিন্তু প্রশ্ন হল, শ্বাসকষ্ট কি শুধুমাত্র করোনার উপসর্গ? একেবারেই তা নয়।
অ্যানিমিয়া, ফুসফুসে ক্যান্সার, এলার্জি, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD), উচ্চ রক্তচাপ, সকষ্টনিক নার্ভে আঘাত (ফ্রেনিক নার্ভ মধ্যচ্ছদার ক্রমিক গতি বজায় রাখতে সহায়তা করে) ইত্যাদি কারণে শ্বাসকষ্ট দেখা যেতে পারে। সুতরাং, একটি পরিষ্কার যে, শ্বাসকষ্ট কেবলমাত্র করোনারই উপসর্গ নয়। শুধুমাত্র শ্বাসকষ্টের ভিত্তিতে কোনো রোগীকে করোনা আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করা, বিচক্ষণতার লক্ষণ নয়।
২. কাশি ও সর্দি:-
করোনার আরেকটি অন্যতম লক্ষণ হল কাশি এবং সর্দি। সাধারণ কাশি ও সর্দিকে অনেকেই গুরুত্বের চোখে দেখেন না। কাশি এবং সর্দির প্রধান কারণ গুলির মধ্যে কয়েকটি হল, ফুসফুসের সমস্যা, রাইনো ভাইরাস অথবা ইনফ্লুয়েঞ্জার মত ভাইরাসের আক্রমণ, ডাস্ট এলার্জি ইত্যাদি। তাই শুধুমাত্র সর্দি ও কাশির লক্ষণকে একমাত্র করোনার লক্ষণ না ধরাই ভালো।
তবে কাশি বা সর্দি সময় সর্বদা সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। সাবধানতা অবলম্বন না করলে অথবা দূরত্ব বজায় না রাখলে, শুধুমাত্র করোনা নয়, অন্যান্য জীবাণুও একজনের শরীর থেকে অন্য জনের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
৩. জ্বর (মূলত ১০০°F এর কাছাকাছি):-
শুধুমাত্র করোনা নয়, অন্য যেকোনো ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাসের, শরীরে আবির্ভাব ঘটলে, জ্বর হওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে, যদি শরীরের তাপমাত্রা ১০০° ফারেনহাইট এর কাছাকাছি থাকে, তবে কেবলমাত্র জ্বরের ভিত্তিতে দাবি করা যায়না যে ওই ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত।
কোন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত করতে, অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করাই শ্রেয়।
৪. গলা ব্যাথা:-
গলা ব্যথা সচরাচর, ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ, ধূমপান, স্ট্রেপটোকক্কাল ফ্যারিনজাইটিস ইত্যাদি কারণে হতে পারে। তাছাড়াও, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে করোনাভাইরাস দেহে প্রবেশ করলে উপসর্গ হিসেবে গলা ব্যথারও আবির্ভাব ঘটছে। কিন্তু, শুধু গলা ব্যাথার লক্ষণ দেখে, ওই ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত কিনা তা নিশ্চিত করা অসম্ভব, কারণ গলা ব্যাথার লক্ষণ শুধু করোনার ক্ষেত্রেই দেখা যায় না, অন্যান্য অসুখের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।
৫. স্বাদ এবং ঘ্রাণের অবনমন:-
স্বাদের অবনমনের বৈজ্ঞানিক পরিভাষা হল, ‘হাইপোগেইসিয়া’ (hypogeusia) এবং ঘ্রাণের অবনমনের বৈজ্ঞানিক পরিভাষা হল, ‘হাইপোসমিয়া’ (hyposmia)।
হাইপোগেইসিয়ার প্রধান কারণগুলি হল, গ্লসোফ্যারিন্জিয়াল স্নায়ুর উপর আঘাত অথবা গ্লসোফ্যারিন্জিয়াল স্নায়ুর ক্ষতি, জ্বর, মস্তিষ্ক অথবা স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত ইত্যাদি। আবার, হাইপোসমিয়ার প্রধান কারণগুলি হল, অলফ্যাক্টরি স্নায়ুর ক্ষতি, প্রদাহ অথবা সাধারণ সর্দি-কাশি।
করোনা আক্রান্ত মানুষের দেহে স্বাদ ও ঘ্রাণের অবনমন দেখা গেলেও, অন্যান্য অনেক শারীরিক কারণেই স্বাদ অথবা ঘ্রাণের অবনমন হতে পারে। তাই এই উপসর্গের জন্য কেবলমাত্র করোনা ভাইরাসকেই দায়ী করা যুক্তিযুক্ত নয়।
৬. মাথা যন্ত্রণা:-
বহু সংখ্যক মানুষই প্রায় প্রতিদিন মাথা যন্ত্রণার শিকার হন। মাথা যন্ত্রণার অন্যতম কারণ হতে পারে দুশ্চিন্তা, মাইগ্রেন, সাইনাস ইত্যাদির সমস্যা। পাশাপাশি, করুনার উপসর্গ হিসেবে দেখা যাচ্ছে মাথা যন্ত্রণার লক্ষণ। তাই, যথাযথ প্রমাণ বা পরীক্ষা ছাড়া মাথা যন্ত্রণার উপসর্গবিশিষ্ট মানুষ যে করণ আক্রান্ত, তা বলা বিচক্ষণতার লক্ষণ নয়।
তবে, সাবধানতার কথা ভেবে এই উপসর্গ গুলির মধ্যে কোন একটি দেখা গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরীক্ষা করানো উচিত, এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা নেওয়া উচিত। কিন্তু, পরীক্ষা না করেই উপসর্গ দেখেই কখনো এক ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত কিনা তা বলা অসম্ভব ব্যাপার। তবে, সাবধানতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) গাইডলাইন অনুসারে উপসর্গ দেখা দিলে, নিজের সুরক্ষা এবং পার্শ্ববর্তী লোকজনের সংক্রমণের আশঙ্কা কমাতে কমপক্ষে ১৪ দিনের জন্য হোম আইসোলেশনে যাওয়া আদর্শ।
উপরোক্ত আলোচনার মধ্যে দেখা যাচ্ছে যে, করোনার উপসর্গগুলির সঙ্গে যথেষ্ট মিল আছে অন্যান্য অসুখের উপসর্গের। এই ফলে উপসর্গ দেখে বিপথে চালিত হচ্ছেন অনেকেই।