উপসর্গহীন নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের প্রয়োজন উপযুক্ত স্ক্রিনিং পরীক্ষা
নিউক্র্যাড হেলথ বাংলা জুন ২১, ২০২০
গত কয়েক মাস ধরে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে যে রোগ প্রবল আকারে ছড়িয়ে পড়ছে আর প্রতিদিন আমাদের উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়ে চলছে, তা হোল কোভিড-১৯। এখনো পর্যন্ত, সারা বিশ্বের ৮২ লক্ষ্যেরও বেশী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া মানুষের সংখ্যা চার লক্ষ্যেরও বেশী। কিন্তু, এই সংখ্যাগুলি স্থিতিশীল নয়। প্রতি মুহূর্তে আমাদের অজ্ঞাতসারে, আক্রান্ত হয়ে চলেছেন বহু সুস্থ মানুষ। এই রোগের জন্যে দায়ী যে অণুজীব, অর্থাৎ SARS-CoV-2 (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম করোনাভাইরাস-২) সে নিঃশব্দে তার রোগের প্রকোপ বাড়িয়েই চলেছে। হাজার নিয়ম, সামাজিক দুরত্বের কড়া অনুশাশন-সব কিছুকে হারিয়ে দিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ লাফিয়ে বেড়ে চলছে কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে হবে। মনে রাখা দরকার, সারা বিশ্বের সর্বস্তরের মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসার পরিভাষায় এই কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষদের প্রধানতঃ দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একঃ যাদের মধ্যে রোগের উপসর্গ আছে, অর্থাৎ ‘সিম্পটোম্যাটিক’ এবং দুইঃ যাদের রোগ উপসর্গ নেই, অর্থাৎ ‘অ্যাসিম্পটোম্যাটিক’। জ্বর, কাশি, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, ইত্যাদি উপসর্গ নিয়ে যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের রক্ত পরীক্ষায় SARS-CoV-2 এর অস্তিত্ব ধরা পড়ছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বা হু (WHO) এর নিয়ম অনুযায়ী, স্পষ্ট ও মৃদু উপসর্গ যুক্ত রোগীদের সত্বর চিহ্নিত করে আইসোলশানে রেখে দ্রুত চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে হবে। এখন সমস্যা হচ্ছে, দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে, অর্থাৎ যারা উপসর্গ বিহীন। তারা যদি কোভিড-১৯ সংক্রমণের শিকার হন, তাদের রক্তের এবং থুথু পরীক্ষার নমুনায় (Swab Test) করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়া অসম্ভব। ফলে, তাদের শনাক্তকরণ যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়ে। নিজের অজান্তেই তারা সুস্থ মানুষকে সংক্রমিত করতে থাকেন আর করোনা নিঃশব্দ ঘাতকের কাজ অবলীলায় করতে থাকে।
সম্প্রতি, চায়নার কংকিন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা বিজ্ঞানীমহলে সাড়া ফেলেছে। ওই ইউনিভার্সিটির ‘ল্যাবরেটরি অফ মলিকিউলার বায়োলজি অন ইনফেক্সিয়াস ডিজিজ’ বিভাগের গবেষকদল, অধ্যাপক আই-লং-হুয়াং এর তত্বাবধানে কোভিড-১৯ উপসর্গ বিহীন এবং স্পষ্ট উপসর্গযুক্ত রোগীদের মধ্যে পরীক্ষা চালিয়ে এক বিশেষ চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপন করেন। তাদের মতে, কোভিড-১৯ সংক্রমিত, কিন্তু উপসর্গবিহীন মানুষের শরীরে অনাক্রম্যতা বা ইমিউনোলজিক্যাল রেস্পন্স ভালো ভাবে তৈরি হয় না। বিশেষ করে, তাদের শরীরে সাইটোকাইন, কেমোকাইনের পরিমান হ্রাস পায়। এছাড়াও এই মানুষদের শরীরে করোনাভাইরাসের নিউক্লিক অ্যাসিডের অস্তিত্ব, ‘রিভার্স ট্রান্সক্রিপশান পলিমারেস চেন রিঅ্যাকশান’ বা RT-PCR করেই নির্ধারণ করতে হয়। কিন্তু, এই পদ্ধতি ব্যায়সাপেক্ষ। তবে উপায় কি? গবেষকদলের মতে, রক্তপরীক্ষা করে রোগীর দেহে নির্দিষ্ট SARS-CoV-2 অ্যান্টিবডি শনাক্ত করা সম্ভব। এই পদ্ধতিকে ‘সেরোলজিক্যাল টেস্টিং’ বলে।
আসলে, কোভিড-১৯ সংক্রমণের সাথে সাথে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে শরীরে তৈরি হতে থাকে প্রধানতঃ ইমিউনোগ্লোবিউলিন-জি (IgG) এবং ইমিউনোগ্লোবিউলিন-এম (IgM) অ্যান্টিবডি। গবেষকপ্রধান অধ্যাপক হুয়াং এর তথ্য অনুযায়ী, সংক্রমণ শুরু হবার ১৭ থেকে ১৯ দিনের মাথায় IgG এবং ২০ থেকে ২২ দিনের ভিতরে IgM অ্যান্টিবডি রোগীর শরীরে পর্যাপ্ত পরিমানে তৈরি হতে থাকে। রক্তে এই দুই ধরনের অ্যান্টিবডির মাত্রাই প্রথম তিন সপ্তাহে বাড়তে থাকে। এরপর, IgM এর পরিমান কিছুটা কমে আসে। ফলে, সেরোলজিক্যাল পরীক্ষার মাধ্যমে এই দুই অ্যান্টিবডির মাত্রা পর্যালোচনা করে, উপসর্গ বিহীন রোগীর দেহে করোনা সংক্রমণের হার জানা সম্ভব। গবেষকদের এই মূল্যবান গবেষণার কাজ ১৮ই জুন বিখ্যাত “নেচার মেডিসিন” পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে, তাদের গবেষণার তথ্য করোনা সংক্রমন ঠেকাতে ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আগামী কিছুদিনের মধ্যেই এই ‘সেরোলজিক্যাল টেস্টিং’ উপসর্গবিহীন করোনা সংক্রমিত রোগী চিহ্নিতকরনে আর করোনা সংক্রমণ রুখতে হয়ে উঠতে পারে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
তথ্যসূত্রঃ
- Long QX, Tang XJ, Shi QL, et al. Clinical and immunological assessment of
asymptomatic SARS-CoV-2 infections [published online ahead of print, 2020 Jun
18]. Nat Med. 2020;10.1038/s41591-020-0965-6. doi:10.1038/s41591-020-0965-6 - https://www.who.int/emergencies/diseases/novel-coronavirus-2019/technical-
guidance/infection-prevention-and-control - https://www.statnews.com/2020/06/09/who-comments-asymptomatic-spread-covid-19/
লেখক পরিচিতিঃ
ডঃ শুভময় ব্যানার্জী
ডঃ শুভময় ব্যানার্জী দিল্লি-র অ্যামিটি ইউনিভার্সিটি-তে ভাইরোলজি এবং ইমিউনোলজি বিভাগে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করেছেন। উনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যান্সার বায়োলজিতে পিএইচডি এবং পরবর্তীকালে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া-র স্কুল অফ মেডিসিন-
এ এবং সিটি অফ হোপ ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট-এ (ক্যালিফর্নিয়া) ভাইরাল অনকোলজি বিষয়ে পোস্টডক্টরাল গবেষণা করেন। সম্প্রতি লেখক অধ্যাপনা, লেখালিখি, ক্যান্সার গবেষণা ও সচেতনতা প্রসারের কাজে যুক্ত।