এই গৃহবন্দী দশায় আপনার পরিবারের কচিকাঁচা সদস্যদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কী করবেন
আজকাল, আমরা যখনই টেলিভিশন বা বা সোশ্যাল মিডিয়া চালু করছি চিরিদিক থেকে কেবল COVID-19 সংক্রান্ত বিভিন্ন খবর ভেসে উঠছে। আমরা প্রাপ্তবয়স্করা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পারছি, তাই লকডাউন সম্পর্কিত সামাজিক বিধি এবং অন্যান্য নিয়মকানুন মেনে চলতে পারছি বা এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পারছি; কিন্তু বাচ্চাদের কাছে এটি একটি চ্যালেঞ্জের হয়ে ওঠেছে।
শিশুরা নিয়মিত স্কুল, এবং খেলার মাঠ ও খেলার সঙ্গীদের কাছে যেতে পছন্দ করে। যখন তারা দীর্ঘ সময় ধরে বাইরে বেরোনোর বা বন্ধুদের সাথে খেলা ধুলা করার সুযোগ পায় না, তখন তাদের মধ্য মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় এবং বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়; যেমন – মনঃসংযোগ করতে অসুবিধা, একটুতেই রেগে যাওয়া, মুড সুইং, ডিপ্রেশন, এমনকি পেট ব্যথা এবং মাথা ব্যথার মতো শারীরিক অসুস্থতাও দেখা দেয়। এই মহামারী চলাকালীন আপনার বাড়ির খুদে সদস্যদের মানসিক এবং শারীরিক যত্ন কিভাবে নেবেন, কিভাবে তাদেরকে ভালো রাখবেন আসুন তার কিছু উপায় বরং আমরা জেনে নিই।
বর্তমান পরিস্থিতি কেটে গিয়ে স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসার আশ্বাস দিন:-
আপনার বাড়ির ছোট ছোট সদস্য বা আপনার সন্তান এই বন্দী জীবন কাটাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে, তারা বাইরে বেরোনোর জন্য, স্কুলে যাওয়ার জন্য খেলাধুলা করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
তাই তারা স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির বড় সদস্যের কাছে বা আপনার কাছে এই মুহূর্তে মহামারীর কি খবর,বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং এর মতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, অর্থাৎ মহামারী সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারা আপনাকে বারবার প্রশ্ন করে তিতিবিরক্ত করবে। এই সময়ে রেগে না গিয়ে যথাযথ ধৈর্য নিয়ে শিশুদের মতো ভাষায় তাদেরকে এই পরিস্থিতির গুরুত্ব এবং সোশ্যাল ডিসটেন্সিং মেনে চলার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করুন। পাশাপাশি তাদেরকে আশ্বাস যে দুর্বিষহ পরিস্থিতি সাময়িক খুব দ্রুত এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে আমরা আবার সেই পুরনো স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে যাব।
মহামারী সংক্রান্ত বিভিন্ন নেগেটিভ খবরগুলি অর্থাৎ এই দিনদিন সংক্রমনের হার বাড়ছে বা কোথায় কত মৃত্যু হল এই ধরনের আলোচনা বাড়ির শিশুদের সামনে করবেন না।
এবং বাড়িতে থাকাকালীন বড়রাও যথেষ্ট হাসিখুশি এবং পজিটিভ ইম্প্যাক্ট নিয়ে থাকার চেষ্টা করুন, যা শিশুদের ওপরেও প্রভাব ফেলবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
ভার্চুয়ালি বন্ধু-বান্ধবদের সাথে যোগাযোগ করানোর চেষ্টা করুন:-
এই সময়ে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু বন্ধু-বান্ধবদের কাছাকাছি দীর্ঘদিন না আসতে পারায় বেশিরভাগ শিশুই ঘরে বন্দি থাকাকালীন অবস্থায় মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই ধরনের সমস্যা যে সমস্ত বাড়িতে একটিমাত্র শিশু তাদের ক্ষেত্রে আরও বেশি। তাই তাদেরকে সঙ্গ দেয়ার চেষ্টা করুন। সাথেই তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে বা বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়দের সাথে টেলিফোনের মাধ্যমে, বা বিভিন্ন ভিডিও কলিং অ্যাপ এর মাধ্যমে যোগাযোগ করানোর, দেখা করানোর, গল্প করার কিছুটা সময় করে দিন। এতে করে তাদের মানসিক চাপ কিছুটা হলেও কম হবে।
বাড়ির ছোটখাটো কাজের দিকেও যুক্ত করুন:-
এই সময় শিশুরা যেহেতু বাড়িতে একদম আবদ্ধ অবস্থায় আছে আপনি বরং চেষ্টা করুন বাড়ির বিভিন্ন ছোটখাট কাজে তাদেরকে কিভাবে যুক্ত করা যায়।
যেমন অল্পবিস্তর ঝাড়পোঁছ করা, রান্নার সময় আপনার সবজি ধুয়ে দেওয়া, আলমারিতে জামা কাপড় ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখা, বইয়ের তাকে বইগুলিকে গুছিয়ে রাখা, বা বাড়ির গাছে জল দেওয়া ইত্যাদি।
অর্থাৎ বাড়ি শিশুদেরকে দিয়ে এমন কিছু কাজ করানোর চেষ্টা করুন যা তাদের কাছে শারীরিক করসতের বা অধিক চাপের না হয়, আবার অন্যদিকে তাদের যে সময়টা বাড়তি সময় সেটাকে কাজে লাগাতে পারে। এই ধরনের ছোটখাট কাজে যুক্ত থাকলে তাদের কিছুটা এনার্জীর ইউটিলাইজেশন হবে সাথে সাথেই ব্যস্ততার কারণে নেগেটিভিটি দূর হবে। আবার এর পাশাপাশি এই ভাবেই তারা আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে, যা পরোক্ষে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করবে।
আপনার সন্তানের শখ গুলিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় দিন, তাকে উৎসাহিত করুন:-
আপনার সন্তানের যেটা শখ সেটার পিছনে কিছুটা সময় ব্যয় করা এই অতিরিক্ত সময়কে কাজে লাগানোর অন্যতম কার্যকর উপায়। আপনার বাচ্চাদের যেসব ক্রিয়াকলাপ অনুপ্রেরণা জাগায় সেগুলি অনুসন্ধান করার চেষ্টা করুন, যেমন গান, নাচ, চিত্রকলা, বাগান করা, লেখা বা বাদ্যযন্ত্র বাজানো।
এই লকডাউন সময় আপনার সন্তানের অনেক সময় বেঁচে থাকে এই সময়টায় পড়াশোনার বিষয়ে অতিরিক্ত প্রেসার তৈরি না করে তাদেরকে তাদের সব গুলো পূরণ করার কিছুটা সময় দিন।
আপনি তাকে সাহায্য করুন, বা যদি তার বেশি সাহায্যের প্রয়োজন হয় তাহলে আজকাল ইন্টারনেটে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়, সেই সমস্ত তথ্য বা টিউটোরিয়াল গুলো ব্যবহার করুন।
বাড়িতে ছোটখাটো ইনডোর গেমস সেশন চালু করুন:-
এই সময় আপনার এবং আপনার শিশুদের হাতে অনেকটা সময় আছে ।তাই বাড়ির সকল সদস্য মিলে একটা সময় খুঁজে বার করুন যে সময়টা আপনারা বাড়ির বড় এবং ছোট সকলে একসাথে বসে ক্যারাম, লুডো, দাবা বা তাস জাতীয় বিভিন্ন ইনডোর গেমস খেলবেন। আপনার বাড়িতে যদি বেশ অনেকটা খোলামেলা জায়গা থাকে তাহলে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, টেনিস এই জাতীয় খেলা খেলতে পারেন।
এতে আপনার প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে যা আপনাকে এই ইনফেকশনস এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করবে। এই বাড়িতে থাকাকালীন অবস্থায় ওজন বেড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায় তা কম করতে সাহায্য করবেঔ, সাথেই মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় থাকবে। এবং সকলে মিলে যদি প্রতিদিন 30 মিনিট করে শৌখ ব্যায়াম অভ্যাস করতে পারে তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
টেলিভিশনে বিনোদন মূলক অনুষ্ঠানগুলি দেখতে পারেন:-
আজকাল, অনেক টেলিভিশন চ্যানেল সমস্ত বয়সের জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচার করছে। সন্ধ্যায় আপনারা সকলে মিলে এই শোগুলি দেখতে পারেন। এর মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের সাথে সুন্দর সময় কাটাতে পারবেন। মহামারীজনিত কারণে সারাদেশে শ্রেণিকক্ষ কার্যক্রম স্থগিত থাকায়, বেশ কিছু চ্যানেল বিভিন্ন বিষয়ে ই-ক্লাস সম্প্রচার করছে। এই শিক্ষাগত অনুষ্ঠানগুলি গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক, কারন সেখানে নেটওয়ার্ক কানেক্টিভিটি সমস্যা বা অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অনলাইন ক্লাস করা সম্ভব হয় না।
আজকে মহামারী চলাকালীন আপনার সন্তানের মানসিক সুস্বাস্থ্য কিভাবে বজায় রাখবেন সে নিয়ে আলোচনা এতটুকুই। ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন।
- বায়োকেমিস্ট ও নিউরোসায়েন্টিস্ট ডঃ বিশ্বরূপ ঘোষ, পিএইচডি (নিউক্র্যাড এলএলসি এবং নিউক্র্যাড হেলথ্ ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা) বর্তমানে আমেরিকায় গবেষণারত ।